আজকের সাংবাদিকতা শুধু খবর সংগ্রহ বা পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক বিস্তৃত ক্ষেত্র যা সমাজের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সংবাদপত্রের কলাম লেখা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টকশো উপস্থাপনা পর্যন্ত—গণমাধ্যমের প্রতিটি ধাপেই রয়েছে নান্দনিকতা, দক্ষতা এবং গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন। সম্প্রতি, চিটাগাং জার্নালিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে তিন ঘণ্টার দীর্ঘ ক্লাসে আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। শিক্ষার্থীরা মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শুনেছে এবং আগ্রহ দেখিয়েছে। সাংবাদিক ফারুক ইকবাল সাহেবের প্রতিষ্ঠিত এই ইনস্টিটিউটটি চট্টগ্রামে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। আজকের আলোচনায় আমরা পত্রিকায় কলাম লেখা, টেলিভিশনে উপস্থাপনা এবং টেলিফোনে সম্প্রচারের ইতিহাস নিয়ে গভীরে যাব। সংবাদপত্রে কলাম লেখার ইতিহাস সাংবাদিকতার ইতিহাস বলতে গেলে সংবাদপত্রকে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় কলাম লেখার সূচনা সাংবাদিকতার শুরুর দিক থেকেই।
প্রথম কলাম লেখকের উদ্ভব আধুনিক সংবাদপত্রে মতামতধর্মী কলাম লেখার প্রথা ইউরোপে শুরু হয় ১৮০০ সালের শুরুর দিকে। তবে এর অনেক আগে, ১৭১১-১৭১২ সালে জোসেফ অ্যাডিসন (Joseph Addison) এবং রিচার্ড স্টিল (Richard Steele) যৌথভাবে সম্পাদিত পত্রিকা The Spectator প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি ছিল মতামত প্রকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং আধুনিক কলামের ভিত্তি স্থাপন করে। ভারতে সংবাদপত্রে মতামতধর্মী লেখা শুরু হয় বেঙ্গল গেজেট (Hicky’s Bengal Gazette) পত্রিকার মাধ্যমে, যা ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল ভারতের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র। বাংলা ভাষায় প্রথম কলাম লেখার চর্চা শুরু হয় ১৯১০-এর দশকে। ‘সোমপ্রকাশ’ এবং ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার পাতায় সেই সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মতামতমূলক কলাম লিখতেন। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কলাম লেখার সূচনা
বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কলাম লেখার প্রচলন শুরু হয় ব্রিটিশ আমল থেকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর এটি ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’, এবং ‘সমকাল’-এর মতো পত্রিকায় বিশিষ্ট লেখকদের কলাম সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করত। কলাম লেখা কেবল মত প্রকাশের মাধ্যমই নয়, এটি ছিল সমাজের অসংগতি, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। মতামতধর্মী লেখার মাধ্যমে কলামিস্টরা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন এবং সমাধানের পথ দেখান।
টেলিফোনে উপস্থাপনার ইতিহাস টেলিফোন আবিষ্কার হলেও দীর্ঘদিন এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক বার্তা, আবহাওয়া প্রতিবেদন এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সরাসরি সম্প্রচারে টেলিফোন ব্যবহারের প্রচলন ঘটে। প্রথম টেলিফোন উপস্থাপনার ইতিহাস ১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল এবং তার সহকারী টমাস ওয়াটসনের মধ্যে প্রথম টেলিফোন সংযোগের মাধ্যমে কথোপকথন হয়। এটি ছিল টেলিফোনের মাধ্যমে প্রথম সফল যোগাযোগ। ১৯০০-এর দশকের শুরুর দিকে ইউরোপে টেলিফোন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লাইভ সংগীত এবং কথোপকথন সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
টেলিভিশন উপস্থাপনার ইতিহাস
টেলিভিশন উপস্থাপনা গণমাধ্যমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধুমাত্র খবর পাঠ নয়, বরং শিল্প, সংস্কৃতি, বিনোদন এবং রাজনীতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। বিশ্বে প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার ১৯৩৬ সালে British Broadcasting Corporation (BBC) বিশ্বের প্রথম নিয়মিত টেলিভিশন পরিষেবা চালু করে। বিবিসির লেসলি মিচেল (Leslie Mitchell) ছিলেন বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন উপস্থাপক। তিনি ছিলেন বিবিসির প্রধান সংবাদ উপস্থাপক এবং প্রথমদিকে সংবাদ, বিনোদন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের পরিচালনা করতেন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩৯ সালে এনবিসি (NBC) বাণিজ্যিক সম্প্রচার শুরু করে। সে সময় নিউজ ক্যাস্টাররা খবর উপস্থাপনের পাশাপাশি নানা ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। বাংলাদেশে টেলিভিশন উপস্থাপনার শুরু বাংলাদেশে টেলিভিশন উপস্থাপনার যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে, যখন ঢাকা টেলিভিশন (বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন বা BTV) প্রতিষ্ঠা করা হয়। আনোয়ারা সুলতানা এবং আলমগীর কবির ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম দিককার টেলিভিশন উপস্থাপক।
‘আমার যত গান’, ‘চিত্রালোক’, এবং ‘নবান্ন’র মতো অনুষ্ঠান ছিল জনপ্রিয় এবং দর্শকপ্রিয়। টকশো উপস্থাপনার ইতিহাস
টকশো-এর ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বে ১৯৫০-এর দশকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের “The Tonight Show” এবং “The Oprah Winfrey Show” ছিল এ ধারার পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশে টকশো জনপ্রিয় হয় ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রচলন বাড়ে। চ্যানেল আই, এনটিভি, এবং একাত্তর টিভির মতো চ্যানেলগুলো টকশো প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমার টেলিভিশন উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার উপস্থাপনা শুরু হলেও, ২০১৭ সালে Bangla TV-তে টকশো উপস্থাপনা শুরু করি। চৌধুরী লোকমান এবং আজাদের মাধ্যমে আমি এই সুযোগ পাই। শুরুর দিকে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। গবেষণার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করি এবং দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করি। Bangla TV-তে আমার উপস্থাপিত বেশ কিছু টকশো ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং আমি একজন সফল উপস্থাপক হিসেবে পরিচিত হই। সাংবাদিকতা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংবাদপত্রের কলাম থেকে টেলিভিশন উপস্থাপনা—প্রতিটি ক্ষেত্রই সমাজকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। গণমাধ্যমের এই বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করতে গেলে প্রয়োজন হয় নিবিড় গবেষণা, অধ্যবসায় এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। চিটাগাং জার্নালিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা যদি এগিয়ে এসে এই পেশায় নিজেদের উৎসর্গ করে, তবে ভবিষ্যতে আমরা আরও দক্ষ, নির্ভীক এবং যোগ্য সাংবাদিক পাবো।