চট্টগ্রামের আবদুল হামিদ সওদাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বর্তমান প্রধান শিক্ষক। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক অভিযোগ এনে যোগদান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে।
প্রধান শিক্ষক অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলমের সঙ্গে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়। পরে তিনি বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং তখন থেকেই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
প্রথম দফায় অভিযোগ এবং বরখাস্ত-
২০১৯ থেকে ২০২১ সালের হিসাব গড়মিল দেখিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়। তিনবার চিঠি দিলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দিয়ে সভাপতির পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করা হয়। এরপর ১৬,৬০,০৪২.৯১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে গত ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এই বরখাস্ত আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে প্রধান শিক্ষক চট্টগ্রাম জজ কোর্টে মামলা করেন (মামলা নং ১২৮/২০২৩)। আদালত মামলাটি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের আপিল ও সালিশি কমিটিতে প্রেরণ করে।
সালিশি কমিটিতে জবাব ও অডিট প্রক্রিয়া- ২০২৩ সালের মে মাসে সালিশি কমিটি প্রধান শিক্ষকের হিসাব উপস্থাপনের সুযোগ দেয়। তিনি তিন বছরের হিসাব জমা দেন এবং বোর্ড নিরপেক্ষ অডিট ফার্ম নিয়োগের নির্দেশনা দেয়। তবে বিদ্যালয়ের সভাপতি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত একটি অডিট ফার্ম দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করেন, যা প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেন প্রধান শিক্ষক। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড পুনরায় দুই পক্ষকে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সালিশি সভায় হাজির হতে বলে। কিন্তু সেখানে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোরূপ হিসাব উপস্থাপন
করতে ব্যর্থ হয়।
বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার ও যোগদানে বাধা- ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রধান শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে পুনরায় দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেয়। এর ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য পদক্ষেপ নেন। তবে বিদ্যালয়ের সভাপতি বিভিন্ন অজুহাতে প্রধান শিক্ষকের যোগদানে বাধা সৃষ্টি করেন। এমনকি তাঁকে হেনস্তা করতে থানায় রেজুলেশন জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দায়ের করেন। থানার তদন্ত কর্মকর্তা তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে মামলা রজু করার হুমকি দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষিত- ২০২৫ সালের ১৪ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকদের হেনস্তা না করার এবং তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়মিত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এই নির্দেশনা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য
প্রধান শিক্ষক বলেন, “বিদ্যালয়ের সভাপতির এ ধরনের কর্মকাণ্ড উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যোগদানে বাধা সৃষ্টি করার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বিদ্যালয়ের স্বার্থবিরোধী এমন আচরণ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য লজ্জাজনক।” তিনি আরও বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা। রেজুলেশনে কোনো জালিয়াতি হয়নি। মূল নথি পরীক্ষা করলেই সত্য উদঘাটন হবে। আমি চাই, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে এবং আমাকে ন্যায়বিচার দেবে।”
প্রধান শিক্ষকের আবেদন- প্রধান শিক্ষক বিভাগীয় কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, দ্রুত তাঁর যোগদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার এবং মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার্থে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
শিক্ষার পরিবেশ হুমকিতে- এ ধরনের ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে বলে মত দিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের একাংশ জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষককে নিয়ে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত সমাধান না হলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সমাজের প্রত্যাশা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অরাজকতা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছে সমাজ। শহীদদের রক্তে গড়া এই দেশ কখনোই শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হতে দেবে না।
প্রধান শিক্ষক লোটন দাশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: ধর্মীয় বৈষম্য ও রাজনৈতিক প্রতিশোধের নির্মম চিত্র- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল হামিদ সওদাগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লোটন দাশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ঘটনা এখন একটি বড় প্রশ্ন তুলেছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ ও নৈতিকতা নিয়ে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রধান শিক্ষক লোটন দাশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের পেছনে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, ধর্মীয় বৈষম্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারই মূল কারণ। ২০১৮ সালের নির্বাচনী কেলেঙ্কারি: ষড়যন্ত্রের সূচনা- ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে রাতের বেলায় ভোট গ্রহণ নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল ইসলাম ভোট কারচুপির জন্য ব্ল্যাংক ব্যালট পেপার সরবরাহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু লোটন দাশ এই অনৈতিক নির্দেশে সাড়া না দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার এই সাহসী সিদ্ধান্তই শাসক দলের নেতাদের কাছে তাকে শত্রুতে পরিণত করে।
এরপর থেকেই লোটন দাশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু হয়। স্কুল পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও তার সহযোগীরা তাকে নানাভাবে হেনস্তা করার পরিকল্পনা করে।
মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মানসিক চাপ সৃষ্টি- বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও তার সহযোগীরা লোটন দাশের বিরুদ্ধে ১৬,৬০,০৪২.৯১ টাকা আত্মসাতের মিথ্যা অভিযোগ এনে তার চাকরি খারিজের চেষ্টা করেন। বাস্তবে, বিদ্যালয়ের হিসাবের সব কাগজপত্র সভাপতির কাছে থাকলেও তিনি তা সরবরাহ না করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছেন। শুধু অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নয়, লোটন দাশের বিরুদ্ধে রেজুলেশন জালিয়াতির অভিযোগও আনা হয়। অথচ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ধর্মীয় পরিচয়কে হাতিয়ার করে ষড়যন্ত্র-
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রধান শিক্ষক লোটন দাশ একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাকে পরিকল্পিতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এই শিক্ষককে “অযোগ্য” এবং “দোষী” প্রমাণ করতে চেষ্টা চালাচ্ছে কিছু প্রভাবশালী মহল। এ ধরনের আচরণ শুধুমাত্র একজন শিক্ষকের মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চরম আঘাত করছে।বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার মর্মান্তিক পরিণতি- এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আরিফুল ইসলামও একই ধরনের মানসিক চাপে ছিলেন। বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের অব্যাহত চাপ এবং ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি এক পর্যায়ে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে লোটন দাশও একই ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, এই চাপ তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির ভয়াবহ প্রভাব- এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ আজ দলীয় রাজনীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একজন প্রধান শিক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে অপদস্থ করা এবং তার পেশাগত জীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত।সমাধানের প্রয়োজন- এই মুহূর্তে লোটন দাশের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগ তদন্ত করে সঠিক বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড। তাদের প্রতি এমন আচরণ চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার মান এবং পরিবেশ বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে দ্রুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।