“প্রতিদিন মানুষ নিয়ে কোনো না কোনো লেখা লিখি, কিন্তু লিখে কোনো লাভ হয় না। মানুষ এক অকৃতজ্ঞ জাতি, তারা কখনোই প্রকৃত মূল্যায়ন করতে জানে না। তাই মাঝে মাঝে পশুপাখি, জীবজন্তু এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করি, কিন্তু তারপরও মনে হয়, আমার লেখা কখনোই তাদের মর্ম বুঝতে পারে না। আমি যখন কুকুর বা অন্য কোনো পশু-পাখি নিয়ে লিখি, তখন যেন মনে হয়, এই ছোট ছোট প্রাণীরা মানুষের চেয়ে অনেক ভালো, একাগ্র ও নিষ্কলঙ্ক।
কুকুরের প্রতি আমার বিশেষ ভালোবাসা। তারা কখনো মানুষের কাছ থেকে কিছু আশা করে না, তবুও বিনা শর্তে আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে। তাদের ভালোবাসা, আনুগত্য এবং সহানুভূতি অনেক সময় মানুষকে অবাক করে দেয়। মানুষের মধ্যে যখন বিবাদ, ক্ষোভ আর আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ে, তখন কুকুরের মতো নির্দোষ প্রাণী আমাদের কাছে বড় শিক্ষাই হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু আজকাল, কেউ কুকুর বা অন্য কোনো পশুর মূল্য বুঝতে চায় না। তাদের প্রতি আচরণ যেন আরও নিষ্ঠুর হচ্ছে। সমাজের এই অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে সবসময় ভাবায়। কুকুর কিংবা অন্য প্রাণীর প্রতি মানুষের যে অসীম ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে, সেই ভালোবাসার কিছু মূল্য পাওয়া উচিত। আজকের দিনে আমি আশা করি, মানুষ নিজের প্রতি যতটা ভালোবাসা পায়, পশুপাখিরাও ততটাই ভালোবাসা পাবে।”
এ পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার প্রাণী রয়েছে, প্রতিটি প্রাণীর নিজস্ব এক আলাদা বৈশিষ্ট্য ও ধর্মীয় তাৎপর্য রয়েছে। আমাদের সমাজে কুকুরকে সাধারণত এক ধরনের নিচু প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কিন্তু ইসলামি বিশ্বাসে এবং ধর্মীয় গ্রন্থসমূহে কুকুরের প্রতি আল্লাহর করুণার এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রাচীন যুগে বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারীর কুকুরের প্রতি সহানুভূতি এবং তার সেই কাজের জন্য আল্লাহর ক্ষমা লাভের ঘটনা প্রমাণ করে যে, একদিনের তৃষ্ণার্ত কুকুরের প্রতি ভালবাসা, সহানুভূতি এবং কর্তব্যবোধ আল্লাহর রহমত লাভের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে।
সাহিহ বুখারিতে একটি হাদিস এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘‘একবার এক তৃষ্ণার্ত কুকুর কূপের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। তৃষ্ণায় তার প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়। বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারী তা দেখে, নিজের পায়ের মোজা খুলে, মোজায় পানি ভরে কুকুরটিকে পানি পান করায়। আল্লাহ তার সে কৃতজ্ঞতাবোধের কারণে তার সব পাপ ক্ষমা করে দেন।’’ (সহিহ বুখারি: ৩৪৬৭)
এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, এমনকি এক তৃষ্ণার্ত কুকুরের প্রতি সদয় আচরণ এবং সহানুভূতি প্রদর্শনও আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের পথ হতে পারে। এটি শুধু কুকুরের প্রতি ভালোবাসা নয়, বরং মানবিকতা, সহানুভূতি এবং আল্লাহর সৃষ্টি প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এক মহান উদাহরণ।
এছাড়া, কুকুরের কৃতজ্ঞতা সম্পর্কে একটি দারুণ শিক্ষণীয় গল্প রয়েছে, যা অনেকটা আমাদের আত্মসমালোচনা করতে প্ররোচিত করে। এক ফকির একদিন একটি কুকুরকে বললো, ‘‘তোর তিনটি অভ্যাস খুর খারাপ।’’
কুকুরটি ফকিরের কথা শুনে উত্তর দিলো:
১. তুই দেয়ালে প্রসাব করিস।
২. তুই ফকির দেখলে ঘেউ ঘেউ করিস।
৩. তুই রাতে ঘেউ ঘেউ করে মানুষের ঘুম নষ্ট করিস।
এই কথাগুলোর উত্তরে কুকুরটি বললো:
১. ‘‘আমি জমিনে প্রসাব করি না, কারণ আল্লাহর কোনো বান্দা হয়তো জমিনে বসে আল্লাহকে সিজদা করণে।’’
২. ‘‘আমি ফকির দেখলে ঘেউ ঘেউ করি, কারণ তারা আল্লাহর কাছে সাহায্য না চেয়ে মানুষের কাছে কেন চায়, তা আমার পক্ষে বুঝতে পারা কঠিন।’’
৩. ‘‘আমি রাতে ঘেউ ঘেউ করে মানুষের ঘুম নষ্ট করি, কারণ তারা গুনাহ করে রাতে আরামে ঘুমালে তারা আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে কবে?’’
এটি একটি চমৎকার শিক্ষণীয় ঘটনা। কুকুরের এই উত্তর আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। কুকুরের উক্তি আমাদের জানান দেয় যে, সে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মনোযোগী। কুকুর, যা সাধারণত মানুষের কাছে একটি সাধারণ পশু, তা কখনো কখনো আমাদের চেয়েও বেশি কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর প্রতি খোদাভীতি ও দায়বদ্ধতা দেখায়।
মানুষের মাঝে অহংকার, লোভ, হিংসা, এবং গুনাহের প্রবণতা অনেক সময় বেশি দেখা যায়। কিন্তু কুকুরের মধ্যে কিছু গুণ রয়েছে যা মানুষকে অনেকটা সাফল্য এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অনুপ্রাণিত করতে পারে। নিচে কুকুরের কিছু গুণ তুলে ধরা হলো:
১. প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা: কুকুরটি কখনো মাটি বা জলাশয়ে প্রসাব করার আগে চিন্তা করে, কারণ সে জানে যে, এই স্থানটি হয়তো কোনো পবিত্র কাজের জন্য ব্যবহার হতে পারে।
২. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা: কুকুরটি ফকিরের উদ্দেশ্যে ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু তার লক্ষ্য হচ্ছে, সে বিশ্বাস করে যে, ফকিররা যেন শুধু মানুষের কাছে না, বরং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই।
৩. অবিচল সতর্কতা: কুকুরের রাতের ঘেউ ঘেউ আমাদেরকে সতর্ক করে। মানুষের যখন গুনাহের মাঝে সুখ-শান্তি থাকে, তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তারা যেন আল্লাহর কাছে তাওবা করে।
আজকের সমাজে, যেখানে মানুষ কুকুরকে প্রায়শই নীচু প্রাণী হিসেবে দেখে এবং তাদের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, সেখানে কুকুরের প্রতি এই হাদিস এবং কুকুরের শিক্ষা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ভালোবাসা, সহানুভূতি, এবং কৃতজ্ঞতা মানবতাকে শ্রেষ্ঠত্বের দিকে পরিচালিত করতে পারে। কুকুরের এই সোজা-সরল আচরণ আমাদেরকে আরও বেশি মানবিক হওয়ার পথ দেখাতে পারে।
অতএব, কুকুরের প্রতি এই মনোভাব ও শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করলে আমরা নিজের জীবনে অধিক কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা এবং সহানুভূতি বিকাশিত করতে পারি। কুকুর, যা সাধারণত নিচু প্রাণী হিসেবে পরিচিত, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার এক মহান উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে, আমাদেরকে মানবতার শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধাবিত করতে পারে। সুতরাং, কুকুরের সাথে আচরণে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করা উচিত।
কুকুর, প্রাণীজগতের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু, মানুষের সহচর হিসেবে বহু যুগ ধরে পরিচিত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কুকুরের ভক্তি, বিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে অসংখ্য ঘটনা ও ঐতিহাসিক বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাসের নানা সময়ে কুকুরের প্রভু বা মালিকের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা আমাদের মনুষ্যত্বের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এই বিশ্বস্ত প্রাণীটির অসীম ভালোবাসা এবং ত্যাগের কাহিনী প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে।
প্রথম ঘটনা: এলিজাবেথ ও কুকুরের বিশ্বস্ততাঃ
এক ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকে জানা যায় যে, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের সময় একবার এক যুদ্ধের পর, তার প্রিয় কুকুরটি তাকে অনুসরণ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিখোঁজ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর কুকুরটি তার প্রভু রাণীর পেছনে পেছনে ফিরে আসে, সেই সময় রাণীটি দুঃখিত এবং অবাক হয়ে কুকুরটির প্রতি ভালবাসা জানিয়ে বলেন, “এমন বিশ্বস্ত প্রিয় বন্ধুকে কখনো হারাতে পারি না।” রাণীর এ অসীম ভালোবাসা এবং কুকুরের বিশ্বস্ততা সবার কাছে এক শিক্ষণীয় ঘটনা হয়ে রইল।
দ্বিতীয় ঘটনা: হাচিকো – ভক্তি এবং বিশ্বস্ততার চিরন্তন উদাহরণঃ
এটি একটি অন্যতম বিখ্যাত ঘটনা, যা আজও মানুষের মনে গভীরভাবে প্রতিস্থাপিত। হাচিকো, এক জাপানি কুকুর, যার মালিক হেইচিরো, প্রতিদিন ট্রেন স্টেশন থেকে অফিসে যাওয়ার সময় তাকে বিদায় জানাতো। একদিন হেইচিরো মারা গেলে, হাচিকো তার মালিকের মৃত্যুর পরও প্রতিদিন স্টেশনে উপস্থিত হতো, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতো। প্রায় ৯ বছর ধরে এই অভ্যাস চলতে থাকে। শেষে, হাচিকো মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার প্রভুর জন্য অপেক্ষা করেছে। আজও হাচিকোর প্রতি বিশ্বস্ততা একটি অন্যতম অসাধারণ কুকুরের ভক্তি হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত।
তৃতীয় ঘটনা: পম্পেই শহরের কুকুরের বিশ্বস্ততাঃ
প্রাচীন রোমের পম্পেই শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এক প্রাচীন কুকুরের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল। এই কুকুরটি তার প্রভুকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে। অগ্ন্যুৎপাতের আগ মুহূর্তে, কুকুরটি তার প্রভুর সামনে এসে লুকিয়ে থাকতে থাকে, যেন সে তার প্রভুকে কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। এই ঘটনা ইতিহাসের অন্যতম এক দৃশ্যমান প্রমাণ যে, কুকুরের ভক্তি এবং বিশ্বস্ততা মানুষ থেকে অনেক বেশি গভীর হতে পারে।
চতুর্থ ঘটনা: ইউরোপীয় সম্রাট এবং তার কুকুরঃ
ইউরোপীয় একটি প্রাচীন সভ্যতায়, এক সম্রাটের কুকুর ছিল এক চরম বিশ্বস্ত সঙ্গী। একদিন সম্রাট শিকার করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পথ হারিয়ে গিয়ে বিপদে পড়েন। তখন তার প্রিয় কুকুরটি তাকে অনুসরণ করে এবং রক্ষাকারী হিসেবে আসে। কুকুরটি সম্রাটের জীবন বাঁচিয়েছিল, এবং সম্রাট তাকে সম্মাননা জানিয়ে ঘোষণা করেন যে, “যে প্রাণী নিজেকে নিবেদন করে, তাকে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়।” এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কুকুরের প্রতি প্রভুর ভক্তি ও বিশ্বস্ততা কত গভীর হতে পারে।
পঞ্চম ঘটনা: ভারতের মহারাজা ও কুকুরের সম্পর্কঃ
ভারতের এক মহারাজা তাঁর কুকুরের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। একবার তিনি তার কুকুরকে এক বিশেষ পদবি দেন এবং তাকে রাজ্যের সবচেয়ে আস্থাশীল সঙ্গী হিসেবে ঘোষণা করেন। কুকুরটির প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ছিল। তিনি জানতেন, তার প্রিয় কুকুরটি কখনো তার বিপদে বিপদে তাকে ছেড়ে যাবে না। মহারাজার এই কুকুরের প্রতি অত্যন্ত বিশ্বাস ছিল এবং তাদের সম্পর্ক ছিল এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের মতো।
এই সব ঐতিহাসিক ঘটনা কুকুরের বিশ্বস্ততা, ভক্তি এবং মানুষের প্রতি অনুরাগের এক গভীর চিত্র তুলে ধরে। কুকুর, যা শুধুমাত্র একটি প্রাণী নয়, বরং মানবজাতির এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী, তার প্রভুর প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দিয়ে তার অমুল্য স্থান দখল করে নেয়। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে, কুকুর কেবল পশু নয়, সে এক বিশ্বস্ত বন্ধু, যে মানুষকে জীবনের কঠিন সময়ে সাহায্য করতে আসে, যেভাবে একজন প্রভু তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা রাখেন। কুকুরের প্রতি প্রভু বা মালিকের ভক্তি আমাদেরকে সত্যিকারের বিশ্বস্ততার মহত্বের শিক্ষা দেয়, যা সব সময় মানবসম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান।