সত্যের সন্ধানে অনুসন্ধান
“চট্টগ্রামে রাতের আঁধারে পরিকল্পিত হামলা: দুই যুবক নিহত, গুলিবিদ্ধ আরও দুইজন – সন্ত্রাসী সাজ্জাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিরোজা বেগমের মামলা দায়ের”
“”অপরাধী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আইনের শাসন ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার শক্তির কাছে তাকে একদিন না একদিন হার মানতেই হয়।”
— ড. ট্র্যাভিস হিরশি, বিশ্বখ্যাত অপরাধবিজ্ঞানীঃ
“আজকের এই লেখা শুরু করতে গিয়ে হাত কাঁপছে, চোখের কোণে জমে আছে অশ্রু। সাংবাদিকতা জীবনে বহু হৃদয়বিদারক ঘটনা লিখেছি, কিন্তু ঈদের মতো পবিত্র ও আনন্দঘন সময়ের প্রাক্কালে এমন এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর লিখতে বসে বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে।”
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে শান্তি—রমজানের তিরিশ রোজা শেষে যখন প্রতিটি ঘরেই ঈদের প্রস্তুতির ব্যস্ততা, তখনই ঘটে যায় এক নিষ্ঠুর, নির্মম হত্যাকাণ্ড। যে ঘরে খুশির আলো জ্বলার কথা ছিল, সেখানে নেমে আসে কান্নার অন্ধকার। এক মুহূর্তেই ঈদের রঙিন স্বপ্নগুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। স্বজন হারানোর যে আহাজারি, তা কেবল ওই পরিবারই জানে—এমন দুঃখজনক সংবাদ লিখতে বসা সত্যিই অন্তরবিদারক।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো নগরজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। গত ৩০ মার্চ দিবাগত গভীর রাতে বহদ্দারহাট এক্সেস রোড সংলগ্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মোঃ বখতিয়ার হোসেন (৩৮) ও আব্দুল্লাহ আল রিফাত (২৫)। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন রবিউল হোসেন হৃদয় ও রবিন নামের আরও দুই তরুণ।
এ ঘটনায় নিহত বখতিয়ারের মা ফিরোজা বেগম গত ১ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরের বাকলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এজাহারে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়েছে চট্টগ্রামের কুখ্যাত সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ওরফে ‘ছোট সাজ্জাদ’-সহ সাতজনের নাম এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৬-৭ জনকে। ঘটনার পেছনের দ্বন্দ্ব ও পরিকল্পনা: এজাহারে বলা হয়, নিহত বখতিয়ার একজন পেশাদার গাড়িচালক ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে সরোয়ার হোসেন বাবলা নামক একজন ব্যক্তির অধীনে গাড়ি চালাতেন। উল্লেখ্য, বাবলার সঙ্গে ছোট সাজ্জাদ ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর পুরনো ব্যবসায়িক বিরোধ এবং প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্ব ছিল।
ফিরোজা বেগমের অভিযোগ অনুযায়ী, সাজ্জাদ ও তার সহযোগীরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার ছেলেকে হত্যা করে। তারা বুঝতে পেরেছিল, বখতিয়ার সরোয়ার হোসেন বাবলার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাকে হত্যার মাধ্যমে বাবলার প্রভাব খর্ব করা যাবে। ঘটনার দিন যা ঘটেছিল:
ঘটনার দিন রাতে বখতিয়ার, রিফাত, হৃদয় ও রবিন একটি গাড়িতে করে নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে বহদ্দারহাটের দিকে যাচ্ছিলেন। রাত আনুমানিক ২টা ৫ মিনিটে রাজাখালী ব্রিজ এলাকায় পৌঁছালে গাড়ির পেছনের চাকা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হয় এবং তারা দেখতে পান, ৬-৭টি মোটরসাইকেলে করে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা তাদের পিছু নিয়েছে।
দুর্বৃত্তরা চলন্ত গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। প্রাণ বাঁচাতে চালক দ্রুত গতিতে চকবাজার এক্সেস রোডের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়। সিরাজ-উদ-দৌলা রোড সংলগ্ন ঢাকাইয়া খানা নামক দোকানের সামনে গাড়িটি থামতেই মোটরসাইকেল আরোহীরা এসে গুলি চালিয়ে বখতিয়ারকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হন রিফাত, যিনি পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আহত হন হৃদয় ও রবিন। ঘাতকরা কারা?
ফিরোজা বেগমের এজাহার অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাতজন হলেন— ১. সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদ (৩৬), কাশেম কলোনি, বাকলিয়া
২. তার স্ত্রী শারমিন আক্তার তামান্না (৩৭)
৩. মোঃ হাছান (৩৬), আমিন কলোনি, বাকলিয়া ৪. মোবারক হোসেন ইমন (২২), পশ্চিম বাকলিয়া ৫. খোরশেদ (৪৫), বহদ্দারহা ৬. রায়হান (৩৫), মধ্যম বাকলিয়া
৭. বোরহান (২৭), গাছবাড়িয়া
এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৬-৭ জন দুর্বৃত্ত ছিল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এজাহারে যা বলা হয়েছে:
ফিরোজা বেগম বলেন, “আমার ছেলে একজন পরিশ্রমী চালক ছিল। সে কারো ক্ষতি করেনি। আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে শুধু একটি প্রভাব বিস্তারের খেলা ও প্রতিহিংসার কারণে। আমি একজন মা হিসেবে তার হত্যার বিচার চাই।” তিনি আরও জানান, ঘটনার সময় আশপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। পুলিশের কাছে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে। পুলিশের অবস্থান:
বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, “আমরা এজাহার গ্রহণ করেছি এবং তদন্ত শুরু হয়েছে। আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করছি।” সমাজের প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ: ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ছোট সাজ্জাদ ও তার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। একাধিকবার অভিযোগ করলেও তারা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে—যদি এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত না হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার পুলিশ চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডার কিলিং মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী ও সরাসরি হামলায় অংশগ্রহণকারী দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা ও গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করে পৃথক অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়। বাকলিয়া থানা পুলিশের এই সফল অভিযান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গ্রেফতার অভিযান ও আসামিদের পরিচয়- হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাকলিয়া থানা পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে। একাধিক অভিযান পরিচালনা করে বাকলিয়া থানা পুলিশ নিম্নলিখিত দুই আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়: ১। মো. বেলাল (২৭) – পিতা: মো. রফিক, মাতা: মর্জিনা বেগম, সাং: ইসলামপুর, সন্দ্বীপপাড়া, লামা, বান্দরবান। বর্তমানে চাঁনগাঁও থানাধীন খাজা রোড বাদামতল এলাকায় বসবাস করছিলেন। গ্রেফতারের সময় তার ঘটনার দিন পরিহিত পোশাক উদ্ধার ও জব্দ করা হয়। ২। মো. মানিক (২৪) – পিতা: মৃত আবুল হাশেম, মাতা: মৃত জরিনা বেগম, সাং: কাঞ্চননগর, অলিপাড়া, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। তিনি এই হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল সরবরাহকারী। তাকে ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। বাকলিয়া থানার পুলিশের অগ্রগতি ও পরবর্তী ব্যবস্থা- গ্রেফতারকৃত দুই আসামিকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে এবং বাকলিয়া থানার পুলিশ মামলার অন্যান্য পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যান্য পলাতক আসামিরা: মো. হাসান (৩৬) মোবারক হোসেন ইমন (২২)
খোরশেদ (৪৫) রায়হান (৩৫)
অজ্ঞাতনামা আরও ৬-৭ জন
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল এবং কারা এই ঘটনার মূল ষড়যন্ত্রকারী, তা উদ্ঘাটনে বাকলিয়া থানা পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি আসামিদের আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাকলিয়া থানা পুলিশের এই সফল অভিযান আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে আস্থা বাড়াবে এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করবে। চট্টগ্রামে পুলিশ কমিশনারের সাহসী অভিযান: ইতিহাস সৃষ্টি করলেন হাসিব আজিজ- চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এক নজিরবিহীন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বর্তমান পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ। একজন পুলিশ কমিশনারের পক্ষে থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে সরাসরি গ্রামে গিয়ে অভিযানে অংশ নেওয়া এক কথায় বিরল দৃশ্য—আর সেটাই বাস্তবে ঘটিয়ে নজির স্থাপন করেছেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরে তিনি চট্টগ্রামের রাউজান, ফটিকছড়ি এবং আশপাশের গ্রামীণ এলাকায় নিজে উপস্থিত থেকে কুখ্যাত অপরাধীদের ধরতে রাতব্যাপী অভিযান পরিচালনা করেছেন। এই অভিযান শুধু একুশ শতকের বাংলাদেশেই নয়, চট্টগ্রামের পুলিশি ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় রচনা করেছে। পুলিশের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে এতে সাহস ও অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে পুলিশের মনোবল যেমন চাঙা হয়েছে, তেমনি তারা জনগণের জন্য আরো নিবেদিত হয়ে উঠছে। সাজ্জাদ-তামান্নার খেলা: চ্যালেঞ্জ প্রশাসনকে- এই অভিযানের পেছনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ গ্রেফতার। সাজ্জাদের গ্রেফতারের পর তার স্ত্রী তামান্না প্রকাশ্যে প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত এক বক্তব্যে তামান্না বলেছিলেন, “খেলা শুরু হলো। আমার স্বামীকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। বান্ডিল বান্ডিল টাকা মারবো—আমার স্বামীকে ছাড়াবো।”
এই বক্তব্য কোনো সাধারণ প্রতিক্রিয়া ছিল না। তা ছিল সংগঠিত অপরাধচক্রের একটি রূপরেখা। সেই বক্তব্যের পরপরই যে ভয়াবহ জোড়া খুন সংঘটিত হয়, তার সঙ্গে তামান্নার পূর্বেকার বক্তব্যের মিল লক্ষ্য করা গেছে। যার কারণে তাকে এই হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়—তামান্নাকে কেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হলো না? যদি তাকে সাজ্জাদের গ্রেফতারের সময়ই আটক করা হতো, তাহলে হয়তো এই জোড়া খুন প্রতিরোধ করা যেতো। এখনো পর্যন্ত তামান্না পলাতক। তার গ্রেফতার অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ও দেশের এজেন্ট-
তদন্তে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর চিত্র। চট্টগ্রামের এই কিলার গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রকরা বসে আছে প্যারিস ও দুবাইতে। বিদেশে বসে তারা দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত করছে। কালুরঘাট ও বোয়ালখালী এলাকার দুই ব্যক্তি এই মাফিয়া চক্রের সক্রিয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। পুলিশ কমিশনারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ মহল এদের সম্পর্কে অবগত। যদি এই দুই এজেন্টকে গ্রেফতার করা যায়, তাহলে এই কিলার চক্রের গোড়া ধরে টেনে বের করে আনা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে পেশাদার খুনিদের গডফাদারদের আসল পরিচয়ও উদ্ঘাটিত হবে। গোপন গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এদের নির্দেশেই ভবিষ্যতে আরও অনেক বড় অপরাধ সংগঠনের ছক তৈরি হচ্ছে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা: ঝুঁকিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা- এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা। যখন পুলিশ কমিশনার বা অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বড় কোনো অপরাধের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন, তখন প্রকৃত সাংবাদিকদের পাশাপাশি কিছু নামসর্বস্ব সাংবাদিক সেখানে হাজির হয়। এদের কেউ কেউ সন্ত্রাসীদের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। তারা সাংবাদিকদের প্রশ্ন, তথ্য বিনিময় এমনকি ছবি ও ভিডিও ধারণ করে সেসব সন্ত্রাসীদের গডফাদারদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এতে করে প্রকৃত অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। তাদের নাম, ছবি, এমনকি অবস্থানও এসব মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এমন অবস্থায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের পরিচয় যাচাই-বাছাই করা একান্ত জরুরি। তাদের পূর্ণ পরিচয় নিশ্চিত না করে কারো সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।
আমার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই কিলার গ্রুপ আমাদের মতো কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককেও টার্গেট করেছে। সেক্ষেত্রে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত যারা সত্য প্রকাশে নিবেদিত, তাদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত। পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের মতো সাহসী, সৎ এবং দায়বদ্ধ কর্মকর্তার হাতে দায়িত্ব থাকলে সাধারণ মানুষের মনে নতুন করে আশার আলো জ্বলে ওঠে। তার সাহসী পদক্ষেপ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, চট্টগ্রাম এখনো অপরাধীদের অভয়ারণ্য নয়। অপরাধীদের যতই আন্তর্জাতিক শক্তি থাকুক না কেন, একজন নিষ্ঠাবান কমিশনার এবং সচেতন জনগণ যদি একযোগে কাজ করেন—তাহলে এই অপরাধ চক্র নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব। একইসঙ্গে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সত্য প্রকাশের পথকে রক্ষা করতে হবে। এটাই সময়, একসাথে দাঁড়াবার। শেষ কথা: একটি প্রশ্নচিহ্ন ও একটাই দাবি-
এই হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রামের বুকের উপর ছুরিকাঘাত। প্রশ্ন উঠেছে—কেন প্রশাসনের চোখের সামনে এই সন্ত্রাসীরা এত দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে? কেন এতদিন তারা প্রভাবশালীদের ছায়ায় নিরাপদ ছিল? আর এখন একটাই দাবি—সুষ্ঠু বিচার। ফিরোজা বেগমের চোখের পানি যেন বিচারহীনতার মরুভূমিতে হারিয়ে না যায়।
চট্টগ্রাম আজ প্রত্যাশা করে একটি সাহসী ও নিরপেক্ষ বিচারের।
কারণ এই লড়াই শুধুমাত্র বখতিয়ারের পরিবারের নয়— এটা আমাদের সকলের অধিকার, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের লড়াই। অপরাধ: পুনরাবৃত্তি ও প্রতিরোধ—বিশ্বের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দৃষ্টিতে- অপরাধ সমাজের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছ।এই ধরনের অপরাধ বারবার সংঘটিত হওয়ার পেছনে রয়েছে দুর্বল জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার এক ভয়ংকর চক্র। বিশ্বের খ্যাতনামা অপরাধ বিশ্লেষক এডউইন সাদারল্যান্ড, যিনি ‘white-collar crime’ বা সুশীল শ্রেণির অপরাধের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন, বলেন—“When institutions are weak, and enforcement is selective, the elite feel empowered to manipulate the system.” বাংলাদেশের মতো দেশে যখন একটি হাসপাতালের কমিটিই যদি বেআইনিভাবে গঠিত হয় এবং সেই কমিটির সভাপতিই হয় দুর্নীতির প্রধান অভিযুক্ত, তখন প্রশ্ন ওঠে—আইন ও নৈতিকতার জায়গা কোথায়?
জার্মান অপরাধতত্ত্ববিদ হান্স গস্তাভ, বারবার সংঘটিত হওয়া অপরাধকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—“Repetition of crime is rarely about opportunity alone. It’s about impunity. If no one is held accountable, crime becomes culture.” চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতালের ঘটনায় দেখা যায়, বছরের পর বছর কমিটির মেয়াদ না থাকলেও কেউ প্রশ্ন তোলে না। যারা ভেতর থেকে প্রতিবাদ করেন, তাঁদের হয়রানির শিকার হতে হয়। বিশ্বাসভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যা শুধু তথ্য নয়, বিবেককে নাড়িয়ে দেয়—তেমন সাংবাদিকদের মতে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানেই ‘Institutionalized Corruption’ গড়ে উঠেছে। বরিশালের সাংবাদিক সালেহ আব্বাস একবার বলেছিলেন, “When patients are numbers, and management is business, hospitals become the new factories of exploitation.” একাধিক অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা গেছে—চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি থামছে না কারণ অপরাধীদের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া। বারবার অপরাধ ঘটার পেছনে রয়েছে— ১. আইনের প্রয়োগের দুর্বলতা
২. প্রশাসনিক নীরবতা ও স্বার্থরক্ষা
৩. সুশাসনের অভাব ৪. জনগণের আওয়াজকে দমন করার প্রবণতা ৫. গণমাধ্যমের ভীতিপ্রবণতা বা বিভক্তি বিশ্বের সফল অপরাধ দমন মডেলগুলো যেমন—হংকং-এর ICAC (Independent Commission Against Corruption) বা সিঙ্গাপুরের দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা, সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শক্তিশালী, স্বাধীন এবং ভয়হীন তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ধরনের “Accountability Architecture” তৈরি না হলে, অপরাধ শুধু বাড়বে না—তা সমাজের মূল স্নায়ুতন্ত্রকে ধ্বংস করবে।
আমি একজন সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে বিগত তিন দশকের পেশাগত জীবনে পৃথিবীর প্রায় ২৮টি দেশে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। এসব দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কর্মশালা ও গবেষণামূলক সফরের মাধ্যমে বিশ্বের খ্যাতিমান অপরাধ বিশ্লেষক, নীতিনির্ধারক, অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই অভিজ্ঞতায় আমি উপলব্ধি করেছি—কেন একটি সমাজে অপরাধ বারবার সংঘটিত হয়, এবং কীভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তা প্রতিরোধ করে। যেসব দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেসব রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত এবং দুর্নীতিবিরোধী কমিশনগুলো কার্যকর ও স্বচ্ছ। অপরদিকে, যেসব দেশে অপরাধচক্র ও দুর্নীতিবাজরা বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, সেসব সমাজে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ই অপরাধের মূল চালিকাশক্তি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের অভিমত অনুযায়ী, অপরাধ নির্মূলের জন্য প্রয়োজন—১. স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, ২. জবাবদিহিমূলক প্রশাসন,
৩. নির্ভীক ও দায়িত্ববান গণমাধ্যম,
৪. এবং সর্বোপরি, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশেও যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো সঠিকভাবে কার্যকর হয়, তবে অপরাধ ও দুর্নীতির এই পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা সম্ভব। না হলে, আমরা কেবল ঘটনা লিখে যাবো, প্রতিবাদ করে যাবো, অথচ অপরাধীরা তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করে নেবে। সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা থেকেই আমি এ কথাগুলো বলছি—কারণ নীরবতা একসময় অপরাধের অংশ হয়ে ওঠে।
##এই অনুসন্ধানীপ্রতিবেদকঃ
সাংবাদিক, লেখক ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ গবেষক এবং টেলিভিশন উপস্থাপক।
চলবে—–