এক বছরেও বিচার না-পাওয়া দারোয়ান শহিদুল্লাহর নির্মম হত্যা : মূল আসামি এখনো অধরার তালিকায়!
চট্টগ্রামের ব্যস্ত শহরের এক কোণে, চান্দগাঁও থানা এলাকায় ছিদ্দিক ম্যানশন নামের ভবনে কাজ করতেন শহিদুল্লাহ নামে এক দরিদ্র দারোয়ান। পিতা-মৃত সিরাজ আহম্মদের সন্তান শহিদুল্লাহ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। জীবনের তাগিদে তিনি শহরে এসেছিলেন নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করতে— স্বপ্ন ছিল ছোট, খুব সাধারণ; মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই আর মা-বোনকে দুবেলা দুমুঠো খাওয়াতে পারা।
কিন্তু ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিল, রমজানের পবিত্রতা ভেঙে এক অমানবিক ঘটনা ঘটে যায়। সামান্য কিছু টাকার চুরির অজুহাতে ভবনের মালিক মোঃ আবু ছিদ্দিক, তার ছেলে শাওন, শ্যালক ফোরকান ও আরও কয়েকজন মিলে সারারাত ধরে শহিদুল্লাহকে পিটিয়ে হত্যা করে। পাশবিকতায় ঠাসা সেই রাতের ভয়াবহতা শহিদুল্লাহর দেহে লেগে ছিল, যা কেউই আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি।
হত্যার পরে, কৌশলে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সাজানো হয় ‘হার্ট স্ট্রোক’-এর গল্প। পরিবারের লোকজনকে ডেকে বলা হয়— শহিদুল্লাহ হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। মৃতদেহ তড়িঘড়ি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীতে, যেন দাফন হয়ে যায় সব প্রশ্ন, সব অভিযোগ। কিন্তু বিধি বোধহয় এবার ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে।
খবর যায় চান্দগাঁও থানায়
ওসি মোহাম্মদ জাহিদুল কবির তখনই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করেন। বাঁশখালী থানার সহযোগিতায় রাতের আঁধারে বাঁশখালী থেকে লাশ উদ্ধার করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্তের জন্য। ময়না তদন্তেই প্রকাশ পায়, এটি একটি স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড।
এরপর পৃথক অভিযানে পুলিশ ফোরকান ও মামুন নামে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। তবে মূল হোতা আবু ছিদ্দিক ও তার ছেলে শাওন ছিল তখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
ভিকটিমের বোন মরিয়ম বোনের দায়ের করা এজাহারে মামলা রুজু হয়— চান্দগাঁও থানার মামলা নং-১০, তাং-০৮/০৪/২০২৪, ধারা-৩০২/৩৪। প্রথম দিকে দৃশ্যত পুলিশ তৎপর ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে সব কিছু যেন থিতিয়ে পড়ে। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রভাবশালী ভবন মালিক আবু ছিদ্দিক মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। তদন্তকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ভিন্ন খাতে, যেন তার নাম মামলার কাগজপত্রে থাকলেও প্রক্রিয়াগত বাধার দেয়ালে আটকে থাকে আইনি পদক্ষেপ।
এক বছর পার হয়ে গেছে। শহিদুল্লাহর মা মমতাজ বেগম আজও একখানা চিঠির আশায় বসে থাকেন— যদি কেউ বলে, “আপনার ছেলের হত্যার বিচার হয়েছে।”
বোন মরিয়ম আজও সেই রমজানের রাতের কথা মনে করে কাঁদেন।শহিদুল্লাহর পরিবার শুধু বিচার চায় না, তারা এই রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন রাখতে চায়—
“গরিবদের রক্তের কোনো মূল্য কি নেই?”
“অর্থবানরা কি সবসময়ই আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যাবে?”
তদন্ত কোথায় থেমে আছে, কেন মূল আসামি আজও ধরা পড়ছে না, কেন জামিন বা প্রভাব খাটিয়ে ফাঁকফোকর দিয়ে পালিয়ে যেতে পারছে অপরাধীরা— এসব প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা।আমরা চাই, এই ঘটনাটি যেন আরেকটি বিস্মৃত ‘কেস নাম্বার’ হয়ে না যায়।
যারা অপরাধ করেছে, তারা ধরা পড়ুক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক।শহিদুল্লাহর রক্ত যেন এই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের দাবিতে জেগে থাকে।আজ এই লেখার মাধ্যমে আমরা শুধু এক হত্যার প্রতিবেদন দিচ্ছি না, আমরা রাষ্ট্রকে জাগিয়ে তুলতে চাই।শহিদুল্লাহের পরিবারের চোখের জলকে আমরা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করছি -যাতে একদিন এই সমাজ বলে উঠতে পারে,
“অবশেষে বিচার হয়েছে।”
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আসল রহিস্য প্রকাশিত হবে–