কিছু কিছু মৃত্যু কখনো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। চোখের সামনে ঘটে যায়, অথচ মন মানতে চায় না—এমন মৃত্যু শুধু হৃদয়ে নয়, সমাজের বিবেকেও রক্তাক্ত দাগ কেটে যায়। রিয়া মজুমদারের মৃত্যু সেই অমোচনীয় ক্ষতের নাম, যে ক্ষত কোনো শব্দে শোক নয়, কেবল প্রশ্ন হয়ে বেঁচে থাকে—এভাবে কি কাউকে মরতে হয়? একজন মেয়ের জীবনের মূল্য কি শুধু একটি বাসের ব্রেক চাপার ভুলেই শেষ? রিয়া মজুমদার আর কখনো তার মায়ের মুখ দেখতে পারবেন না। ২৫ বছরের এই তরুণীটি হয়তো সেদিন ভাবতেও পারেননি, যে পথ দিয়ে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরেন, সেই চেনা রাস্তাই হবে তার জীবনের শেষ পথ।
গতকাল মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড়ে ঘটে এই মর্মান্তিক ঘটনা। অফিস শেষে বেরিয়েছিলেন তিনি, অসুস্থ মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দ্রুত বাসে উঠে পড়েন। বাসের ভিড় ঠেলে একটু
কষ্ট করে হলেও নামার চেষ্টা করেন গন্তব্যে পৌঁছে। কিন্তু সেই নামাটা আর শেষ হলো না। যাত্রী ওঠা-নামার জন্য নির্ধারিত কোনো স্টপেজ বা নিয়মকে তোয়াক্কা না করে, ৭ নম্বর বাসটি মাঝ রাস্তার মোড়েই থেমেছিল। সেখান থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান রিয়া। আর তখনই পেছন দিক থেকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসা ২ নম্বর বাসটি তাকে পিষে দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। পাশে পড়ে থাকে তার হাতের ব্যাগ, যেখানে ছিল মায়ের জন্য কেনা ওষুধ।
এই মৃত্যু কোনো ‘দুর্ঘটনা’ নয়। এটি আমাদের ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক উদাসীনতা, এবং পরিবহন ব্যবস্থার বর্বর চেহারার আরেকটি নির্মম প্রমাণ। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটছে। বাস, টেম্পু কিংবা সিএনজি—সবই যেন নিজ নিজ নিয়মে চলে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো এখানে নিয়মের বাইরে নয়, বরং নিয়মই হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসগুলো যাত্রী তোলার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে, কে আগে যাত্রী তুলবে, কে আগে মোড় পাড়ি দেবে—এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় প্রতিদিন কেউ না কেউ হারায় প্রাণ।
অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বাস বা টেম্পুর স্টিয়ারিংয়ের পেছনে বসছে অনভিজ্ঞ চালকরা। তাদের হাতে কোনো নিয়ম নেই, ট্রাফিক সিগন্যাল মানার প্রয়োজন নেই। এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়—সব দেখেও যেন কিছুই দেখছে না পুলিশ প্রশাসন। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা যেন নিছক দর্শকের, শুধু দাঁড়িয়ে থাকা—কোনো হস্তক্ষেপ নেই, প্রতিরোধ নেই, প্রয়োগ নেই।
এই অবস্থার দায়ভার শুধু বাসচালক বা মালিকদের নয়, দায়ভার পুলিশের, প্রশাসনের, এমনকি আমাদের সবার। আমরা যারা প্রতিদিন এই রাস্তায় চলি, আমরা জানি এখানে কী ধরনের নৈরাজ্য চলে। আমরা দেখেও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এই অভ্যস্ততা একেকটা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে—রিয়ার মতো অসংখ্য তরুণ-তরুণী, বাবা-মা, শিশু। তাই রিয়ার এই মৃত্যু ‘দুর্ঘটনা’ শব্দ দিয়ে ধুয়ে ফেলা যাবে না। এটি সরাসরি হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের দায় বাস দুটো সমানভাবে বহন করবে, তাদের মালিকরা বহন করবে, আর সবচেয়ে বড় দায় পুলিশের, যারা আগেভাগেই এসব রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। শহরের প্রতিটি মোড়ে যাত্রী ওঠানামার নির্ধারিত স্টপেজ নিশ্চিত করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে।
সব ধরনের গণপরিবহন চালক ও সহকারীদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স পরীক্ষা করতে হবে।
আর সবচেয়ে জরুরি—ট্রাফিক পুলিশকে নিছক দর্শক থেকে দায়িত্বশীল রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে।
রিয়ার মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—যতক্ষণ পর্যন্ত এই নৈরাজ্য চলবে, ততক্ষণ প্রতিটি পরিবার আতঙ্কে থাকবে, কে কখন পথে বেরিয়ে ফিরবে না, কেউ জানে না। এই মৃত্যুর প্রতিকার একটাই—আইনের কঠোর প্রয়োগ, মানবিক পরিবহন ব্যবস্থা, এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতা। রিয়ার জন্য ন্যায়বিচার মানেই, আর কোনো রিয়া যেন হারিয়ে না যায় শহরের বেপরোয়া গতির নিচে।