কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবারের মতো “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যবহার করেন ১৯২৬ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত কবিতা “খেয়াপারের তরণী”-তে। এই কবিতায় নজরুল ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন।
কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার দৈনিক পত্রিকা “সাপ্তাহিক সওগাত”-এ। এটি নজরুলের রাজনৈতিক ভাবনার গভীরতা এবং দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রকাশ।
কবিতাটি:
খেয়াপারের তরণী –
আমাদের মুক্তি তুমি
তুমি আমাদের প্রাণ,
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ!
তোমারি পানে জাগে উঠেছে
আমার হৃদয় বাণ।
শ্মশানে কাঁদিছে শকুন,
মড়া তব গায়ে,
মৃত্যু তোমার শিয়রে দাঁড়ায়ে
ফোটে গোরের ফুল।
আমরা কি ভয় করিব?
কবর ফুঁড়ে আবার
বেরিয়ে আসিব প্রাণ।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ!
তোমারি পানে জাগে উঠেছে
আমার হৃদয় বাণ।
এই কবিতায় নজরুল প্রথমবার “বাংলাদেশ” শব্দটি ব্যবহার করে জাতির আত্মপরিচয় ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর লেখনীতে এ শব্দটি বাংলা জাতিসত্তার প্রতীক হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ নামটি আমাদের দেশের নাম হিসেবে গৃহীত হওয়ার পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় “বাংলাদেশ” শব্দের প্রথম ব্যবহার আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে এই নামের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছে। তবে “বাংলাদেশ” নামটি রাষ্ট্রের পরিচিতি হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে মূলত বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষত পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
“বাংলা” শব্দের উৎপত্তি:
“বাংলা” শব্দটি এসেছে প্রাচীন গঙ্গারিডি (Gangaridai) থেকে, যা বাংলার প্রথম পরিচিত নাম। মধ্যযুগে বাংলার সুলতানি ও মুঘল শাসনামলে এ অঞ্চলকে “বাংলা” বলা হতো।
ব্রিটিশ শাসনকাল (1757-1947):
ব্রিটিশ শাসনামলে পুরো বাংলাকে “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি” বলা হতো। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় “পূর্ব বাংলা” নামে পরিচিত অঞ্চলটি পূর্ববঙ্গ ও আসামের একটি অংশে পরিণত হয়।
পাকিস্তানি শাসনকাল (1947-1971):
ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হয় এবং এর নাম হয় “পূর্ব পাকিস্তান”। তবে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ক্রমেই সোচ্চার হতে থাকে।
“বাংলাদেশ” নামের রাষ্ট্রীয় ব্যবহার: বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন:
১৯৬০-এর দশকে যখন বাঙালিরা পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ “বাংলাদেশ” নামকে বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
প্রথম রাজনৈতিক ব্যবহার:
১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রতিবাদে “বাংলাদেশ” শব্দটি উঠে আসে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “বঙ্গবন্ধু হল” উদ্বোধনের সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী “বাংলাদেশ” শব্দটি উচ্চারণ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ নাম গ্রহণের আহ্বান জানান।
স্বাধীনতার ঘোষণা:
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে “বাংলাদেশ” নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আনুষ্ঠানিক নামকরণ:
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে “বাংলাদেশ” নামটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়।
বাংলাদেশ নামের তাৎপর্য:
“বাংলাদেশ” শব্দটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত:
“বাংলা”: যা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
“দেশ”: যা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয় বহন করে।
বাংলাদেশ নামটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এবং এটি আমাদের জাতীয় গৌরব ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
চলবে–