আবদুল্লাহ আল নোমান—এই নামটি শুধু একজন রাজনীতিবিদের পরিচয় নয়, এটি একটি সাহসিকতার উপাখ্যান, একটি সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি।
তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বীর, ছিলেন গণমানুষের কণ্ঠস্বর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিচল এক পাহাড়।
রাজনীতিকে তিনি দেখেছেন দেশসেবার মহান ব্রত হিসেবে, আর মন্ত্রীত্বকে গ্রহণ করেছেন দায়িত্ব ও স্বচ্ছতার প্রতীক হয়ে।
আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বে তিনি থেকেছেন আলোর পক্ষে, থেকেছেন সত্যের পক্ষে—অপরাজনীতির রক্তচক্ষুকেও করেননি ভয়। আবদুল্লাহ আল নোমান কেবল দলীয় রাজনীতির নেতা নন, তিনি সময়ের সাহসী উচ্চারণ, যিনি প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার নাম হয়ে বেঁচে থাকবেন বহুদিন। চট্টগ্রামের রাজনীতি, আন্দোলন, উন্নয়ন এবং মানবিকতা—সব মিলিয়ে যাঁরা একটি ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সফল মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান নিঃসন্দেহে অন্যতম। তাঁর নাম উচ্চারণ করলেই যেন চট্টগ্রামের ইতিহাসের পাতায় এক গৌরবময় অধ্যায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে যিনি হেঁটেছেন সততা ও সংগ্রামের দীপ্ত আলো হাতে নিয়ে, যিনি প্রতিটি পদক্ষেপে দেশের মাটি, মানুষের কথা ভেবেছেন; তিনিই আমাদের নোমান ভাই। আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য পেয়েছি—প্রায় চার দশক ধরে। এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি শুধু একজন রাজনীতিক নন, হয়ে উঠেছিলেন আমার জন্য এক আস্থার আশ্রয়, এক নির্ভরতার নাম।
আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় ১৯৮৮ সালে, যখন চট্টগ্রামে শিক্ষা আন্দোলনের উত্তাল সময়। তখন থেকেই তিনি আমাকে স্নেহভরে ‘কামাল’ বলে ডাকতেন। সেই ডাকের মধ্যে ছিল পিতৃস্নেহ, ছিল রাজনীতিক সহযাত্রীর সম্মান, ছিল এক অমলিন সম্পর্কের আভাস।
১৯৯৪ সালে লালদীঘির মাঠে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আয়োজনে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান চলছিল। সেই বিশাল জনসমাবেশে নোমান ভাই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আমি তরুণ সমাজসেবক ও শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে পুরস্কার পেলাম তাঁর হাত থেকে। তিনি শুধু পুরস্কার দেননি, আমার ২৭ মিনিটের বক্তব্য শুনে আমার পিঠে হাত রেখেছিলেন, বলেছিলেন, “তুমি থেমো না কামাল, তোমার কণ্ঠে আমি দেশের ভবিষ্যৎ দেখতে পাই।”
২০১০ সালে আবার একবার তাঁর হাত থেকে পেলাম নবীন সেন সাহিত্য পুরস্কার। আমি তখন তাঁকে আমার গবেষণাধর্মী বই ‘বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচনি তথ্য-উপাত্ত’ উপহার দিই। বইটি হাতে নিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে পাতা উল্টে দেখছিলেন, হঠাৎ থেমে বললেন, “এই বই একদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে।” সেই বাক্যটি আজও আমার প্রতিটি লেখায় অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে রয়ে গেছে।
তিনি বইপ্রেমিক ছিলেন। আমি তাঁকে পরে আরও তিনটি বই উপহার দিই। একবার আমার উপস্থাপনায় বাংলা টিভির টকশোতে অংশ নিতে এসে আমি তাঁকে ‘জানা অজানা কথা’ বইটি দিই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বইটি উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, “এই সেরা বই। কামাল, তুমি থেমো না। লিখে যাও। এই দেশ, এই চট্টগ্রাম তোমার কলমের জন্য অপেক্ষা করছে।” সেই মুহূর্তে তাঁর চোখে যে উজ্জ্বল প্রশংসা ঝলক দিয়েছিল, তা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিগুলোর একটি।
২০০২ সালে যখন আমি আলজেরিয়ায় বিশ্ব যুব সম্মেলনে যাচ্ছিলাম, তিনি আমাকে এক হাজার ডলার দিয়েছেন হাতখরচ হিসেবে। বলেছিলেন, “তুমি দেশের প্রতিনিধি। তোমার পরিচয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল হোক।” তাঁর এই উদারতা শুধু আর্থিক নয়, তা ছিল এক ধরণের নীরব পৃষ্ঠপোষকতা, যে উৎসাহ আমাকে সাহস জুগিয়েছে বারবার।
২০০৩ সালে মুসলিম লীগের প্রবীণ নেতা এম এ সালাম সাহেবের স্মরণসভায় আমি যখন অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলাম, তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের আক্তারুজ্জামান বাবু চৌধুরী, মন্ত্রী জাফরুল ইসলামসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা। সেই বিশাল আয়োজনে, তাঁর কানে কানে বলা একটিমাত্র বাক্য আজও আমার মনপ্রাণ নাড়িয়ে দেয়—”কামাল, আমি মারা যাওয়ার পর তুমি আমার জন্য একটা নাগরিক স্মরণসভা ও সালাম সাহেবের মতো একটা স্মারকগ্রন্থ লিখে দিও।” কী গভীর আস্থা, কী নির্মল বিশ্বাস, কী অনুপম অনুরোধ—আজ তিনি নেই, কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ইনশাআল্লাহ আমি এই দায়িত্ব পালন করব।
২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন, আমি ‘দৈনিক ভোরের আওয়াজ’–এ তাঁর নিয়ে একটি বিশেষ লেখা প্রকাশ করি, যেখানে প্রথম পাতার শিরোনামে তাঁকে স্থান দিই। সেটিই সম্ভবত তাঁর জীবদ্দশার শেষ কোন পত্রিকায় আমার লেখা ছিল। তাঁর মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে আমি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনসারদের একটি অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করি। এই ঘটনাগুলোর মাঝে এমন এক কাকতালীয় মিল রয়েছে যা আজ আমার ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা সৃষ্টি করে। যেন ঈশ্বর চাইছিলেন আমি তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে থাকি।
তাঁর সঙ্গে আমার আরও বহু স্মৃতি—চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সহযোগিতা, টকশোতে অংশগ্রহণ, আমার লেখালেখি বিষয়ে তাঁর উৎসাহ, সব মিলিয়ে তিনি যেন আমার রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক জীবনের এক অন্তরঙ্গ অভিভাবক হয়ে ছিলেন।
তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন আবেগপ্রবণ মানুষ, একজন রুচিশীল পাঠক, একজন আত্মবিশ্বাসী চিন্তাবিদ। তাঁর মতাদর্শ, তাঁর ভদ্রতা, তাঁর কণ্ঠের দৃঢ়তা, তাঁর নেতৃবাচক নেতৃত্ব—সবই আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
তিনি বলতেন, রাজনীতি হলো মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, ইতিহাসের দায়বদ্ধতা থেকে। এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি এক জীবন পার করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমি অনুভব করি, চট্টগ্রাম এক সন্তানকে হারিয়েছে, বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন অভিজ্ঞ, পরিচ্ছন্ন ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরকে।
আমি, মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, আজ তাঁর প্রতি এই লেখার মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাঁর স্মৃতি অম্লান রাখতে আমি তাঁর উপর একটি স্মারকগ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করব। আমি জানি, এতে হয়তো আমার চোখে জল আসবে, কিন্তু কলম থামবে না—কারণ নোমান ভাই বলেছিলেন, “তুমি থেমো না কামাল। চট্টগ্রামের মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।”
আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন