বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘিরে দেশে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার অজুহাতে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকামুখী সমাবেশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ২০০ থেকে ২৫০ জন নেতাকর্মীকে ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে। এসব কর্মসূচির পেছনে রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবে তা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিএসবি) এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জেলার সকল থানাকে সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে বলেছে। ৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে জারি করা স্মারকে ডিএসবি অফিস, চট্টগ্রাম থেকে ‘জরুরি বিশেষ বার্তা’ পাঠানো হয়েছে সকল থানার অফিসার ইনচার্জদের নিকট।
বিশেষ বার্তায় পুলিশ প্রশাসনের প্রতি যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা হলো:
১. ঢাকামুখী নেতাকর্মীদের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ: সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে তৃণমূল নেতাদের ওপর নজর রাখা এবং সন্দেহভাজনদের তথ্য সংগ্রহ করা। ২. মোবাইল ট্র্যাকিং ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে পলাতক আসামিদের গ্রেফতার: যাদের বিরুদ্ধে পূর্বে দায়েরকৃত মামলা রয়েছে, তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ৩. গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন ও যানবাহন তল্লাশি: রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, নৌঘাটসহ পরিবহনের কেন্দ্রস্থলে কড়া নজরদারির পাশাপাশি ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারগুলোতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের শনাক্ত করতে হবে।
৪. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি: উসকানিমূলক বক্তব্য ও গুজব ছড়ানো পোস্ট শনাক্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৫. রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান ঠেকাতে স্থানীয় স্তরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা: বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করে এই বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৬. অর্থদাতাদের চিহ্নিত করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ: বিশৃঙ্খলার অর্থ জোগানদাতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ সংগ্রহ ও আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।
আসন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় যা যা করতে বলা হয়েছে: পুলিশ কন্ট্রোল রুম, চট্টগ্রামে প্রতিদিন রাত ১২টা থেকে পরবর্তী দিন রাত ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংঘটিত গ্রেফতার, চেকপোস্টের সংখ্যা, আটক সন্দেহভাজন ও অন্যান্য তথ্য একটি নির্দিষ্ট ছকের মাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে পাঠাতে হবে। এই তথ্যগুলো একীভূত করে ঢাকাস্থ এসবি সদর দপ্তরে সকাল ৮টার মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। প্রশাসনের কঠোর মনোভাবের পেছনে যুক্তিসংগত আশঙ্কা রয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, রাজনীতির নামে সৃষ্ট ‘জনসমাগম’ পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা বলছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির আড়ালে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি, চিহ্নিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও মামলা-মোকদ্দমায় পলাতক অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠে। তাই সরকার ও প্রশাসনকে ধোঁকা দিয়ে এই ধরণের কর্মসূচি বাস্তবায়নের পেছনে থাকা চক্রান্তকে প্রতিহত করাই এখন সময়ের দাবি। চট্টগ্রাম ডিএসবি পুলিশের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তারা বলছেন, “রাজনীতির নামে বিশৃঙ্খলা ও ফ্যাসিবাদকে যদি সময়মতো দমন করা না যায়, তবে তা দেশের স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”
‘দেশের স্বার্থে প্রয়োজন হলে কঠোর ব্যবস্থা নেব’ — বলছেন থানার ওসিরা, বিশেষ বার্তার আলোকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে একযোগে তৎপরতা শুরু করেছে পুলিশ। ইউনিয়নভিত্তিক তালিকা প্রস্তুত, গোপন নজরদারি, চেকপোস্ট স্থাপন, মামলা থাকা পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে বিশেষ মোবাইল টিম গঠনসহ নানা কার্যক্রম চলছে পুরো জেলাজুড়ে।
তবে এ সব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা কী ভাবছেন? দৈনিক ভোরের আওয়াজ–এর পক্ষ থেকে কয়েকজন অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, তারা এই নির্দেশনাকে সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ওসি বলেন,
“আমরা দেশের মানুষের জানমাল রক্ষায় সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিক ব্যানার ব্যবহার করে যদি রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। জনগণ শান্তি চায়, আমরা সেটাই নিশ্চিত করব।”
আরেক থানার ওসি জানান,
“গোপন তৎপরতা এবং গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা অনেক আগেই প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রতিটি ইউনিয়ন নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতারও করা হচ্ছে।”
তাঁরা আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উসকানিমূলক অপপ্রচারের মাধ্যমে যাঁরা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছেন, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সন্দেহজনক অর্থ লেনদেন ও ভাড়া করা পরিবহন নিয়েও তদন্ত চলছে।
এক ওসি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন,
“ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার পুনরুত্থান ঠেকাতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশকে কেউ অশান্ত করতে চাইলে, সেটা সে যেই হোক না কেন, আমরা রেহাই দেব না।”
ওসিদের সমন্বিত বার্তা থেকে স্পষ্ট যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশ ও মানুষের নিরাপত্তা রক্ষায় এখন আগের চেয়ে বেশি প্রস্তুত, তৎপর এবং অটল। তাদের মতে, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে রাজনীতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই রাজনীতির আড়ালে যারা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। পুলিশ যথেষ্ট সতর্কতা ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে, যাতে কোনো নিরীহ মানুষ অকারণে হয়রানির শিকার না হয়—এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি পদক্ষেপে মানবাধিকার ও ন্যায়ের মানদণ্ড বজায় রাখা জরুরি। সন্দেহবশত কাউকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রেও সংবেদনশীলতা ও পেশাদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই, পুলিশ হবে জনবান্ধব, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সুবিচার নিশ্চিত করার প্রতীক। যেন জনগণ ভয় নয়, আস্থা নিয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হতে পারে। এজন্য প্রতিটি অভিযান বা তল্লাশির আগে প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও মানবিক বিবেচনা অত্যাবশ্যক। আর এভাবেই গড়ে উঠবে এক নিরাপদ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।