বৈশাখ আসে প্রতিবার, নব সূর্যের আহ্বানে। আসে হৃদয়ে উন্মাদনা, জীবনে নতুনের রঙ ছড়াতে। কিন্তু এবারের বৈশাখ যেন গানে-ভাসা এক অনন্য অধ্যায় হয়ে উঠল—যার কেন্দ্রজুড়ে ছিলেন এক শিল্পী, যার নামেই যেন সুরের অভিষেক ঘটে—আলিফা পুতুল।
বাটালি হিলের সবুজ ঘেরা শতায়ু অঙ্গনের মঞ্চে, বৈশাখী বিকেলের আড়ালে যখন পাখির কূজন আর মৃদু বাতাসের দোলায় প্রকৃতি আপন সুরে কথা বলছিল, তখনই সেই সুরের ঢেউয়ে ভেসে উঠলেন তিনি—আলিফা পুতুল। একে একে গাইলেন “একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে”, “আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইবো কথা”, “এই মন তোমাকে দিলাম”—প্রতিটি গান যেন একেকটি মনছোঁয়া গল্প, যা হৃদয়ের গোপন কোনে গোপনে গেঁথে যায়।
পুতুলের কণ্ঠে গান শুধু গান নয়, এক নিঃশব্দ বিপ্লব। আজকের সময়ে যখন অনেকেই জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটে লোকদেখানো গান গেয়ে মঞ্চ দখল করেন, তখন পুতুল যেন তার গানে এক নির্মল বাতাসের স্পর্শ এনে দিলেন। তার গানে নেই বাহুল্য, নেই কৃত্রিমতা, নেই আত্মপ্রচারের চাতুর্য—ছিল শুধু গভীর আত্মমগ্নতা আর মাটি-ঘ্রাণমাখা এক শিল্পসত্তা।
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে যখন তার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো, আমি বুঝে গেলাম—আমি কেবল একজন উদীয়মান শিল্পীর সঙ্গে কথা বলছি না, কথা বলছি যেন এক ডানাকাটা পরির সঙ্গে, যার কণ্ঠে গান যেমন সুন্দর, মানুষ হিসেবেও তেমন বিনয়ী, লাজুক ও ভদ্র। তার সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা—যিনি যেন আলিফার জীবনের ছায়াসঙ্গী। আলিফা জানালেন—বাবার কর্মসূত্রে চট্টগ্রামের মেয়ে হলেও, তার মায়ের বাড়ি কুমিল্লা। ছোটবেলা থেকেই গান শিখেছেন, এখনো শেখেন—বিশেষত ক্ল্যাসিকাল সংগীত। গানের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
এই অল্প সময়ে অনেক কথা হলো, অনেক ভাবনার আদান-প্রদান ঘটল। আমি তাকে আমার লেখা পড়ে শোনালাম—যা আমি তার গান শুনতে শুনতে হৃদয় দিয়ে লিখেছিলাম। লেখাটি হাতে পেয়ে তার যে অসাধারণ আনন্দের ঝিলিক আমি দেখেছি, তা সত্যিই আমার লেখকজীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। আমি জীবনে অসংখ্য শিল্পীকে নিয়ে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছি, সাক্ষাৎকার নিয়েছি, কিন্তু এই মেয়েটির চোখে যে সম্ভাবনার দীপ্তি দেখেছি, তা সত্যিই দুর্লভ।
আমার বিশ্বাস—যদি আমরা আলিফার মতো শিল্পীদের যথাযথ সহযোগিতা করি, তাহলে তারা শুধু একজন শিল্পী হয়ে থাকবেন না, হয়ে উঠবেন আমাদের জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি। তার গানে যে সরলতা, গভীরতা ও বাংলার আবেগ আছে, তা আজকের সময়ে বড় প্রয়োজন।
পুতুল দেখতে যেমন পুতুল, তেমনি তার কণ্ঠেও যেন পুতুলের মতোই এক নির্মল সৌন্দর্য রয়েছে। আমি চাই—এই মেয়েটি জাতীয় পর্যায়ে গান করার সুযোগ পাক, বাংলা গানের আসল আসনে জায়গা করে নিক। আমাদের সংস্কৃতিতে এমন শিল্পীর উত্থান মানে বাংলা গানের নবজন্ম।
বৈশাখের এই বিকেল যেমন কেটে গেছে, তেমনি বহু বৈশাখ আসবে-যাবে। কিন্তু বাটালি হিলের সবুজে ঘেরা সেই মঞ্চে, বৈশাখী হাওয়ার মাঝে যে কণ্ঠ বেজে উঠেছিল, তার সুর আজীবন রয়ে যাবে মনের গহিনে। সেই কণ্ঠের নাম—আলিফা পুতুল।