নতুন সূর্য উঠেছে আজ। চারদিকে আলপনার রেখা, বাতাসে শাড়ি-পাঞ্জাবির খসখস, উৎসবের ঢেউ বয়ে চলেছে শহরের অলিতে-গলিতে। বৈশাখ এসেছে তার চিরচেনা জাঁকজমক নিয়ে—পান্তা-ইলিশের গন্ধ, ঢোলের শব্দ, গানের তালে শরীর দুলে ওঠে নিজের অজান্তেই। শতায়ু অঙ্গনের আয়োজনে তাই আজ সকালটা হয়ে উঠেছিল এক পূর্ণাঙ্গ বাঙালিয়ানার উৎসব—কবিতা, গান, আড্ডা, হাসি আর সেই চিরচেনা ঐতিহ্য, যা হারিয়ে যেতে বসেছে নগরজীবনের কংক্রিটে।
কিন্তু এইসবের মাঝখানে, আমার আনন্দ ছিল অন্যখানে। শত লোকের ভিড় পেরিয়ে আমার চোখ খুঁজছিল দুইটি ছোট মুখ—হাসান আর তার ছোট ভাইকে। পথশিশু বললে ভুল বলা হবে, ওরা আসলে রাজপথের রাজপুত্র। ঘুমায় ফুটপাতে, শরীর ঘামে গরমে, ভিজে যায় বৃষ্টিতে, কিন্তু চোখে তবু স্বপ্ন জ্বলে। আমি তাদের দেখেছি প্রতিদিন ভোরে—আমার শরীরচর্চার সময় ওরাও আসে, ছেঁড়া জামা গায়ে, তবু কেমন প্রাণময় চোখে তাকায়।
গতকাল, উৎসবের টুকেন না পেয়ে ছোট্ট মুখ দুটো কেমন কেঁচে গিয়েছিল। বুকটা কেমন করেছিল তখন—ভাবলাম, উৎসব যদি সবার না হয়, তাহলে সেটা কিসের উৎসব? রাতে চুপিচুপি চেরাগি পাহাড় মোড়ের দোকান থেকে কিনে আনলাম দুইটা নতুন পাঞ্জাবি। দাম খুব বেশি নয়, কিন্তু ওদের মুখে যে হাসি ফুটলো তা কোনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না।
সকালবেলা যখন ওদের হাতে দিলাম পাঞ্জাবি আর পান্তা-ইলিশের টুকেন, তখন দেখলাম রাজপুত্রেরা সত্যিকারের রাজপুত্র হয়ে গেছে! চোখে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন, মুখে প্রশান্তির হাসি, বুকভরা সাহস—যেন আজকের বৈশাখটা শুধু ওদের জন্যই সাজানো। ওরা আর ‘পথশিশু’ নয়, ওরা আমার অতিথি।
অনুষ্ঠান চলছিল মঞ্চে—কেউ গান গাইছে, কেউ কবিতা পড়ছে, কেউ আবার আড্ডায় হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো দিনের গল্পে। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম হাসান আর তার ভাইয়ের পাশে, তাদের নতুন জামায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল বাতাস। মনে হচ্ছিল, এটাই তো আমার বর্ষবরণ। এখানে আমার পরিচয় একজন আয়োজক নয়, একজন মানুষ।
এই দুইজনের মুখে হাসি দেখেই আজ মনে হয়েছে, আমি নতুন কিছু করেছি। হাজারো শিশুর জন্য কিছু না পারলেও, এই দুইজনের হাতে একটুকরো ভালোবাসা তুলে দিতে পেরেছি। ভাবতে ভালো লাগে, এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওরা ভুলে গিয়েছিল ফুটপাথের কষ্ট, রোদ-বৃষ্টি আর খিদে। প্রতিদিন দেখি এই শহরে শিশুরা ঘুমায় খোলা আকাশের নিচে, কুকুরের পাশে, ইটের বিছানায়। গরমে ঘেমে ভেজে যায়, বৃষ্টিতে কাপড় ভিজে ঠান্ডা লাগে—কিন্তু কারো চোখ পড়ে না ওদের দিকে। সমাজের বিত্তবানরা নতুন জামা পরে উৎসব পালন করে, আর হাসানদের মতো শিশুরা তাকিয়ে থাকে দূর থেকে।
আজকের সকালটায় আমি সেই দেয়ালটা ভেঙে ফেলেছি—যেটা আমাদের আর ওদের মধ্যে এতদিন ছিল। আমি চাই, শুধু আমি না—এই শহরের প্রতিটি মানুষ অন্তত একজন হাসানকে খুঁজে পাক। কারণ ওদের চাওয়া খুব বেশি নয়, একমুঠো ভাত, একটা ভালোবাসার জামা, আর একটু সম্মান। শতায়ু অঙ্গনের এই আয়োজন সফল হয়েছে শুধু সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নয়, মানবিকতার দিক দিয়েও। আমরা প্রমাণ করেছি, উৎসব শুধু গানে আর পোশাকে হয় না—হয় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে, কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারলে। আজ আমি গর্বিত, কারণ আমি নতুন বছরে কিছু নতুন করেছি। নতুন চেতনায়, নতুন ভাবনায়, নতুন স্পর্শে। এই লেখা আমি লিখছি যেন কোনো একদিন কেউ পড়ে বলে—“এই তো সত্যিকারের বর্ষবরণ, যা কেবল মুখে নয়, অন্তরে বাজে।” আসুন, নতুন বছরে নতুন শপথ নিই—আরেকটি হাসানকে খুঁজে বের করি। তাকে বলি, “তুইও আমাদের মতোই মানুষ, তোরও আছে স্বপ্ন দেখার অধিকার।”
শুভ নববর্ষ ১৪৩২।
এই বৈশাখ হোক সব হাসানদের মুখে চিরন্তন আনন্দের প্রতিচ্ছবি।