সিএনজি চালক থেকে কোটিপতি: ‘থানার সোর্স’ পরিচয়ে টাইগার পাসে এমরানের ভয়ঙ্কর চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আতঙ্ক, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষোভ
একজন সাধারণ সিএনজি চালকের এত অর্থ-বিত্ত আসে কোথা থেকে? এই প্রশ্ন এখন চট্টগ্রামের টাইগার পাস, আমবাগান, ঝাউতলা ও আশপাশের এলাকার মানুষের মুখে মুখে। এমরান নামের এক ব্যক্তিকে ঘিরে সম্প্রতি ভয়াবহ চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। নিজেকে পুলিশের ‘সোর্স’ পরিচয় দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এই ব্যক্তি গড়ে তুলেছেন এক অদৃশ্য ক্ষমতার বলয়—যেখানে ভয়, ভীতি, দখলদারিত্ব ও দাপটই নিয়ম।
এক সময়ের অতি সাধারণ এই মানুষটি এখন টাইগার পাস এলাকায় নিজের দোতলা বাড়ির মালিক। রয়েছে একটি দামি নোহা মাইক্রোবাস, দুটি সিএনজি অটোরিকশা। শুধু তাই নয়, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে রয়েছে একাধিক জায়গা-জমি, যেগুলোর বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
তবে এই সম্পদ কীভাবে এসেছে—তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হকার বলেন, “এই লোকের তো আগে কিছুই ছিল না। এখন দেখি দামী গাড়িতে ঘোরে, গায়ে দামি কাপড়, পেছনে লোকজন। অথচ প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়, না দিলেই শুরু হয় হামলা, হুমকি।”
টাইগার পাস, ঝাউতলা, ওয়ারলেস, খুলশি থানা এলাকা—প্রতিটি জায়গায় এমরান আক্ষরিক অর্থেই ছড়িয়ে রেখেছেন নিজের নিয়ন্ত্রণ। ফুটপাতে বসা চা বিক্রেতা থেকে শুরু করে পুরাতন যন্ত্রাংশের দোকান, কাঁচাবাজার কিংবা মোবাইল এক্সেসরিজের হকার—সবাই তাকে দিতে বাধ্য হন দৈনিক বা সাপ্তাহিক চাঁদা। ‘পুলিশি ছায়ায় চলাফেরা’
অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগের সময় কিছু স্থানীয় নেতা ও পুলিশের ছায়ায় চলেছে তার এই দৌরাত্ম্য। পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা, থানায় ঢোকা-বেরোনো, মাঝে মাঝে অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার নাটক—এসব কৌশলে তিনি নিজেকে পুলিশের সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে সাধারণ মানুষ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও ভয় পেতেন। টাইগার পাস এলাকার একজন প্রবীণ দোকানদার বলেন, “ওর আসল শক্তি হল ভয় দেখানো আর রাজনৈতিক দাদাদের ব্যবহার করা। পুলিশও চুপ থাকে, কারণ বলে, ‘ও সোর্স’। অথচ আমরা জানি, সে কোন সোর্স না—ও নিজেই অপরাধী।”
রাজনৈতিক ‘পালাবদল’ ও পুরনো কৌশল
৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোড় ঘুরতেই এমরানও ঘর বদলেছেন। এবার তিনি বিএনপি ঘরানার কয়েকজন নেতার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে চাঁদাবাজির ধরন বদলায়নি—একইভাবে চলছে ভীতি প্রদর্শন, জোরপূর্বক টাকা আদায়। পরিবর্তন শুধু মাথার উপরের ছাতা।
এলাকার এক চা দোকানি বলেন, “ওর এখন নতুন দাদারা আছে। আগেও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল, এখন বিএনপির লোকজন। আসলে আমরা জানি, কারো না কারো নাম ভাঙিয়ে ও শুধু টাকা তুলে।” প্রতিরোধের প্রস্তুতি-
সম্প্রতি কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদার একত্র হয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ছবি, ভিডিও এবং চাঁদা আদায়ের তারিখ ও পরিমাণ সংবলিত নথি প্রস্তুত করেছেন বলে জানিয়েছেন। এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা আর চুপ থাকব না। অনেক হয়েছে। এখন গ্রুপ করে এর বিরুদ্ধে মামলা করব। প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকলে, এই অপশক্তির বিচার হবেই।”
প্রশাসনের ভূমিকা ও স্থানীয়দের দাবি
এখন প্রশ্ন উঠছে—প্রশাসন এতদিন কেন নীরব ছিল? কেন একজন ব্যক্তি পুলিশের নাম ভাঙিয়ে এত দিন চাঁদাবাজি চালাতে পারল? স্থানীয়দের দাবি, শুধু এমরান নয়—যারা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
তাদের স্পষ্ট ভাষায় দাবি, “এই চাঁদাবাজি শুধু টাকা নেওয়া নয়, এটা আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নষ্ট করছে। দোকান বন্ধ হচ্ছে, লোকজন ভয়ে এলাকা ছাড়ছে। প্রশাসনকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো জনগণ নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।”