নাঈমা সুলতানা—নামটা শুনলেই যেন হৃদয়ের নিভৃত কোনে ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে যায়। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা, যেখানে ভাষাহীন কথারা খেলা করে। সৌন্দর্য, শালীনতা আর আত্মবিশ্বাস—এই তিনে গাঁথা তাঁর উপস্থিতি ঠিক যেন এক অজানা কবিতার প্রথম পঙক্তি, যার অর্থ বোঝার আগেই হৃদয় দোলা দেয়।
এইরকমই কিছু একরত্তি অনুভব নিয়ে শুরু করেছি এই রাতের গল্প…
এক রাতের মুখোমুখি–
রাতে অনেক সময়ই অদ্ভুত কিছু মুহূর্তের জন্ম দেয়। শহর যখন ক্লান্তির আড়ালে নিভে যেতে চায়, ঠিক তখনই হঠাৎ কোনো আলো এসে জেগে তোলে এক নতুন গল্প—যেটা লেখা হয় না কাগজে, শুধু হৃদয়ে জমা থাকে।
ভিআইপি টাওয়ারের উপরে
“সামস” চাইনিজ রেস্টুরেন্টের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। দিনের ব্যস্ততা পেরিয়ে, রাতে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার সময়। হঠাৎই লিফটে ওঠার ঠিক আগমুহূর্তে দেখা হয়ে গেল এক অনন্য নারীর সঙ্গে—সুশৃঙ্খল, আত্মমর্যাদায় দীপ্ত, মুখে প্রশান্ত হাসি।
তিনি এগিয়ে এসে বললেন,
“ভাই, চিনতে পারছেন না?”
চোখে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল—এই মুখ তো ভোলার নয়। অথচ ভুলেই ছিলাম! অস্বস্তির এক টুকরো ঢেউ ভেসে গেল বুকজুড়ে। আমি লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
“দুঃখিত, এত ভালো মানুষের মুখ মনে রাখতে না পারাটা আমার দুর্ভাগ্য…”
তিনি হেসে বললেন,
“আমি নাঈমা সুলতানা, এসপি, পিবিআই।”
সেই নাম যেন মুহূর্তেই চিনে নিল হৃদয়। পুলিশের উচ্চ পদে থাকা একজন নারী, কিন্তু কথার ভঙ্গিমায় কোথাও কোনো দম্ভ নেই—আছে আত্মবিশ্বাস, সৌজন্য আর একধরনের নির্মল মায়া।
একসাথে লিফটে উঠলাম আমরা। ধীরে নিচে নামছিল লিফট, অথচ সময় যেন থেমে ছিল কয়েকটি সেকেন্ডের জন্য। কথার সুযোগ এলেই আমি বললাম,
“আপনাকে নিয়ে আরো কিছু লিখতে চাই- আপনি আমাকে সময় কখন দেবেন???
আমি তাঁকে আমার ভিআইপি টাওয়ারের বাসায় আসার নিমন্ত্রণ জানালাম। তিনি হাসলেন, বললেন,
“ইনশাআল্লাহ, একদিন দেখা হবে।” লিফটে ওঠার –
রাতের সংক্ষিপ্ত মুহূর্তে পুরনো একটি স্মৃতি আবার জেগে উঠল মনে—প্রথম সাক্ষাৎ, যখন আমি তাঁর অফিসে গিয়েছিলাম। তখনই তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম আমার লেখা দীর্ঘ গবেষণার ফসল ‘সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কথা’ বইটি।
সেটা ছিলো কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই, কেবল একজন লেখকের পক্ষ থেকে একজন চিন্তাশীল পাঠকের প্রতি শ্রদ্ধা। তাঁর চোখে তখন যে মনোযোগ দেখেছিলাম, সেটা সহজেই ভুলে যাওয়ার নয়।
আবারও পুনরায় এই রাতের মুখোমুখি হওয়া, কিছু নির্লিপ্ত বাক্য, একটুখানি হাসি, আর মনে জেগে ওঠা পুরনো স্মৃতিরা আজও আমাকে জাগিয়ে রাখে। মনে হয়, আমি একজন বিরল চরিত্রকে স্পর্শ করেছিলাম কিছুটা সময়ের জন্য।
এভাবেই ধীরে ধীরে, নাঈমা সুলতানা—একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন মানুষ, আর একজন বিস্ময়কর নারী—আমার লেখার পাতায় জীবন্ত হয়ে উঠছেন। তখনই টের পেলাম, কিছু মানুষ আছেন—যাদের নাম উচ্চারণেই এক ধরনের কবিতা ঝরে পড়ে, যাদের উপস্থিতি যেন প্রাসঙ্গিকতা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে প্রেরণা। নাঈমা সুলতানা তেমনই একজন—যিনি কেবল একজন পুলিশ অফিসার নন, তিনি এক স্পর্শযোগ্য সৌন্দর্যের অনুরণন, এক বর্ণময় চরিত্র, যিনি কল্পনার সীমা পেরিয়ে বাস্তবের পাতায় হেঁটে আসেন নিঃশব্দে। আমি যখন বল্লাম আপনাকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে চাই-
তিনি যখন বললেন, “লিখেন ভাই,” তখন আমার মনে হলো—এই তো সেই মুহূর্ত, যার জন্য অনেকদিন ধরে কলম অপেক্ষায় ছিল। একদম নিঃশব্দে, বিনা আলোড়নে—এই সাক্ষাৎ যেন হয়ে গেল সাহিত্যের অলিখিত অনুচ্ছেদ।
কিছু মানুষ কবিতা হয়ে ওঠেন, কিছু মুহূর্ত গল্প। আর কিছু সন্ধ্যা এমনই, যা কেবল স্মৃতিতে নয়—চিরস্থায়ী হয়ে থাকে ভালোবাসার পাতায়।
এ উপন্যাস সেই এক সন্ধ্যার, সেই এক হাসির, আর সেই এক অদ্ভুতভাবে হৃদয়ে গেঁথে যাওয়া নামের—নাঈমা সুলতানা।
চলবে—