অনুসন্ধানী প্রতিবেদন –১
চট্টগ্রাম বন্দরে তরফদার তন্ত্র: সাংবাদিকতার মুখোশে লুটপাটের গোপন কারখানা”
চট্টগ্রাম বন্দর লুটের মহাযজ্ঞে ‘সাংবাদিক দালালি’ ও প্রেসক্লাব কব্জার নেপথ্য কাহিনিসহ রুহুল আমিন তরফদারের বিভিন্ন অপকর্মের কথা দৈনিক ভোরের আওয়াজ-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের উঠে আসছে–চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ নয়— এটি একটি কৌশলগত সম্পদ, একটি আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বার। অথচ এই বন্দরকেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো ব্যবহার করেছেন এক বিতর্কিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী— রুহুল আমিন তরফদার। তার পেছনে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজনৈতিক আশীর্বাদ, আর সামনে ছিল সাংবাদিকতা ও প্রেসক্লাবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের নিখুঁত কৌশল।
রুহুল আমিন তরফদার ক্ষমতার বলয়ে প্রবেশ করেন মূলত রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ২০০৮-এর পর। এরপর থেকেই বন্দরের কোটি কোটি টাকার লিজ, টেন্ডার ও সরবরাহ ব্যবস্থায় তার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এক সময় তার কোম্পানিগুলো ছাড়া যেন বন্দর চলতেই পারত না— এমন একটি মনোভাব দৃষ্টিগোচর হয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে, তরফদারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার প্রকল্পে বিনা প্রতিযোগিতায় কাজ পেয়ে আসছে। কাগজে কলমে এসব চুক্তির বৈধতা থাকলেও বাস্তবে এগুলো ছিল রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে বরাদ্দ পাওয়া। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায় শুরু হয় তখন, যখন তরফদার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য হয়ে যান এবং একে একে তার অনুগত কিছু সাংবাদিককে প্রেসক্লাব কমিটি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার অংশ করে নেন। ক্লাবের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে এক ধরনের ‘তরফদার বলয়’— যাদের কাজ ছিল সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখা এবং প্রয়োজন হলে নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের হুমকি দেয়া।
একজন প্রাক্তন ক্লাব সদস্য জানান, “এই বলয়ের সদস্যরা শুধু তরফদারের পক্ষে কথা বলতেন না, বরং যারা তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে চাইতেন, তাদের সাংবাদিক সমাজ থেকে একঘরে করে দিতেন।”
তরফদার নিয়মিতভাবে এই সাংবাদিকদের আর্থিক সহযোগিতা করতেন— কেউ মাসোহারা পেত, কেউ বিদেশ সফরের সুবিধা, কেউ পেত চুক্তিভিত্তিক প্রজেক্ট। ফলত, তার বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট ছাপা হওয়ার আগেই থেমে যেত।
এই সাংবাদিক-ব্যবসায়ী আঁতাতের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে শুরু হয় এক অদৃশ্য লুটের সংস্কৃতি। বন্দর থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন, ঘাট লিজ, পণ্য পরিবহন এবং ক্রেন ভাড়াসহ অসংখ্য খাতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। অথচ এসব বিষয়ে কেউ টু শব্দটিও করে না। যে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন তোলার কথা, তারাই হয়ে উঠেন মিথ্যার ঢাল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা তরফদার হাতিয়ে নিয়েছেন, তা দিয়ে দেশের একটি পুরো বিভাগকে উন্নয়নের আওতায় আনা যেত। কিন্তু এই অপচয় ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি শুধুমাত্র ‘গোল্ডেন সাইলেন্স’-এর সংস্কৃতির জন্য— যেখানে পয়সা আর প্রভাবের কাছে বিবেক বিক্রি হয়ে গেছে। সাংবাদিকতা পেশা নয়, এটি একটি দায়িত্ব। কিন্তু যখন কিছু তথাকথিত সাংবাদিক নিজের স্বার্থে কলম বন্ধ করে দেন, কিংবা টাকা আর সুবিধার বিনিময়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন, তখন তা শুধু পেশার মর্যাদাকেই ধ্বংস করে না— সমাজকেও অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
রুহুল আমিন তরফদারের বিরুদ্ধে কথা বলা কঠিন ছিল— কারণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন মানেই ছিল প্রেসক্লাব থেকে চাপে পড়া, মিথ্যা অভিযোগে বিব্রত হওয়া, কিংবা চাকরি হারানোর আশঙ্কা।
চট্টগ্রামবাসী এখন একটাই প্রশ্ন করছে— চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব কি সাংবাদিকতার দুর্গ, নাকি ক্ষমতাসীন ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চৌকি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদেরই, যদি সত্যিকার অর্থে আমরা গণতন্ত্র, মুক্ত সাংবাদিকতা ও চট্টগ্রামের উন্নয়ন চাই। চট্টগ্রাম বন্দর—দেশের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার, অথচ বছরের পর বছর ধরে এ বন্দরের ভেতরে চলে আসছে নানামুখী অনিয়ম, জট ও স্বার্থনির্ভর সিদ্ধান্তের প্রবাহ। আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি, দক্ষ জনবলের অভাব, লজিস্টিকস ও জেটি ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা—এসব সমস্যা পেরিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং তাকে ঘিরে এক বিতর্কিত অপারেটরকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা।
এই অপারেটর আর কেউ নন—সাইফ পাওয়ারটেকের মালিক তরফদার রুহুল আমিন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে এনসিটি অপারেট করার সুযোগ পেয়ে আসছিলেন। টেন্ডার ছাড়া দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এনসিটি পরিচালনার সুবিধা তিনি পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের একাংশের ছত্রছায়ায়। বর্তমানে যখন তাঁর অপারেটরের মেয়াদ শেষের পথে, তখন তাঁর পুনর্বাসনের জন্য এক নতুন কৌশল দৃশ্যমান হচ্ছে—যেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে বন্দরের ভবিষ্যৎ, শ্রমিকদের স্বার্থ ও জাতীয় রাজস্ব। তরফদার রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরেই অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ব্যতীত লিজ পাওয়া, চুক্তির মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে নেওয়া এবং বন্দর ব্যবস্থাপনায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের। ২০১৫ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক ‘ডেপথ ম্যানেজমেন্ট’ পদ্ধতিতে এনসিটির দায়িত্ব পেলেও এরপর থেকে প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার ছাড়াই তিনি বন্দর ব্যবসা চালিয়ে যান।
তৎকালীন সময়ে তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, এমপি এম এ লতিফ ও নোয়াখালী-৪ এর সংসদ সদস্য একরামুল করিম। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন এই সকল রাজনীতিক ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছেন। ঠিক তখনই তরফদার রাজনৈতিক ছায়া বদল করে নতুন ঠিকানার সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।
চট্টগ্রামে একটি মহল হঠাৎ করেই এনসিটির বিদেশি হস্তান্তর নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। অতীতে যারা কখনো বন্দর ইস্যুতে আলোচনায় আসেননি, তারাই এখন ধারাবাহিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের ‘চিন্তিত’ বলে প্রকাশ করছেন। বক্তৃতায় উঠে আসছে এমন সব তথ্য ও বিশ্লেষণ—যা মূলত তরফদারপন্থী বক্তব্য বলেই পরিচিত।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই মহলের বক্তব্যের ভাষা ও তথ্যসূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেগুলো তরফদার রুহুল আমিনের নিজস্ব অবস্থানের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এমনকি তরফদার নিজেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “তাঁরা যথার্থই বলছেন।” এই বক্তব্যে অনেকে মনে করছেন, এটা মূলত নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ, যাতে রাজনৈতিক আবরণ দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করা যায়।
এই নাটকের পেছনে রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ—বিশ্বখ্যাত সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বন্দর অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ড। এপ্রিল মাসে ঢাকায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংস্থাটির চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েমের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর থেকেই এনসিটি ইস্যুতে একাংশের ‘উদ্বেগ’ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। অনেকেই বলছেন, এই ‘উদ্বেগ’ নিছক কাকতাল নয়—বরং এটি তরফদার রুহুল আমিনকে পুনর্বাসনের জন্য সাজানো একটি পরিকল্পনার অংশ, যাতে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনার আড়ালে আবারও পুরনো অপারেটর সুবিধাভোগী হিসেবে ফিরে আসতে পারেন। চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য প্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এমন একটি কৌশলগত স্থাপনাকে ঘিরে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের সংঘাত যদি চলতেই থাকে, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। একজন বিতর্কিত অপারেটরকে পুনর্বাসনের এই চেষ্টার ফলে—শ্রমিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হবে,
প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ভেঙে পড়বে, এবং দীর্ঘমেয়াদে চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্নীতির গভীর বলয় তৈরি হবে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—একজন ব্যবসায়ীর স্বার্থরক্ষায় যখন রাজনীতি ব্যবহার হয়, তখন জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে, আর রাষ্ট্রীয় সম্পদে নেমে আসে নৈতিক বিপর্যয়। চট্টগ্রাম বন্দর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান—জনগণের অর্থনৈতিক প্রাণ। কিন্তু বারবার এই বন্দর ব্যবস্থাপনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার ফলে প্রমাণিত হচ্ছে—আমরা এখনও একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক বন্দর ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। তরফদার রুহুল আমিনের ঘটনাটি সেই দুর্বলতার নগ্ন প্রকাশ। সময় এসেছে, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের বাইরে গিয়ে জনগণের সম্পদ রক্ষায় জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অদ্ভুত মোড়—যেখানে অতীতের ক্ষমতাধররা আজ পলাতক, আর তাদের ছায়াতলে থাকা এক ‘ক্যাশিয়ার’ আজ আবার উঠে আসতে চাইছে নতুন ছদ্মবেশে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সাবেক শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা বর্তমানে পলাতক। তারা দেশের রাজনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়া থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। কিন্তু যিনি একসময় তাঁদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন—অর্থ ব্যবস্থাপক ও কথিত ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত তরফদার রুহুল আমিন—তিনি এখন আর পেছনে নেই।
পলাতক অবস্থায় না থেকেও রুহুল আমিন তরফদার নিজেকে ধীরে ধীরে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মানিয়ে নিচ্ছেন। গোপনে আঁতাত করে এগিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে। অতীতের পলাতকদের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে এখন তিনি সক্রিয়ভাবে জড়াচ্ছেন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ মহলের সঙ্গে।
প্রশ্ন উঠছে—যে মানুষটি একসময় বিতর্কিত অর্থ লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন, তিনি কীভাবে আবারও রাজনীতির আলোয় আসছেন? কারা তাঁকে গ্রহণ করছে? কেন তাঁকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে?
এই প্রেক্ষাপটে তরফদার রুহুল আমিন শুধু একটি চরিত্র নয়—তিনি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্নের প্রতীক। যদি এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি আবার ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের সুযোগ পান, তবে তা গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ—তা ভাবনার বিষয়।
আজ, যখন সাবেক শাসকেরা আত্মগোপনে, তখন তাঁদের প্রাক্তন ক্যাশিয়ার নতুন করে জায়গা করে নিচ্ছেন শাসনব্যবস্থার ভেতরে—এই দৃশ্যপট আমাদের নতুন করে সতর্ক করে দেয়। ইতিহাস যেন আবার নিজেদের পুনরাবৃত্তি করছে, কেবল চরিত্রগুলো বদলে গেছে।
এখন প্রয়োজন সতর্ক দৃষ্টি, নিরপেক্ষ তদন্ত ও জনগণের প্রশ্ন। কারণ, যে দেশে পলাতকদের প্রেতচ্ছায়া ঘুরে বেড়ায়, সেখানে গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখা এক কঠিন দায়িত্ব।