"চট্টগ্রামে ওয়াসিম চক্রের দৌরাত্ম্য: চোলাই মদ পাচার থেকে গরু ডাকাতি পর্যন্ত—পাহাড়ি কৃষকদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র"
চট্টগ্রাম থেকে ফিরে বিশেষ প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পশ্চিম চরণদ্বীপ এলাকার বাসিন্দা ওয়াসিম (পিতা: আব্দুস চোবান) এখন আর শুধুই এক নাম নয়—পাহাড়ি এলাকার নিরীহ কৃষকদের কাছে তিনি এক আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। চোলাই মদের অবৈধ ব্যবসা থেকে শুরু করে সশস্ত্র গরু ডাকাতি—তার নেতৃত্বে গঠিত সংঘবদ্ধ একটি চক্র বছরের পর বছর ধরে রাঙ্গুনিয়া ও আশপাশের এলাকায় দাপটের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অপকর্ম।
বিশেষ করে রাউজান উপজেলার পাঁচখাইনের চিহ্নিত অপরাধী ও পলাতক আসামি খালেক মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াসিম গড়ে তোলে একটি ভয়ংকর সিন্ডিকেট। ২০২৩ সাল থেকে তারা নিয়মিতভাবে রাঙ্গুনিয়ার শরফভাটা পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করে দেশীয় চোলাই মদ সংগ্রহ করে। এই মদ নদীপথে পাচার করে তারা শহরে বিক্রি করত, আর এই পুরো কার্যক্রম চলত স্থানীয় কিছু মাদক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছায়ায়। শুধু পাচারই নয়—ওয়াসিমের দলের ছিল অস্ত্রধারী একটি বাহিনী, যারা গরিব কৃষকদের ভয় দেখিয়ে মদ ছিনিয়ে নিত এবং একইসঙ্গে গবাদিপশুও লুট করত। শরফভাটার নিরীহ কৃষক আব্দুর রহমান, যিনি পেশায় একজন গরু পালনকারী, এক সন্ধ্যায় এই চক্রের নির্মম শিকার হন। তিনি জানান, “সন্ধ্যার ঠিক আগে আমি পাহাড়ে চড়তে দেওয়া ৭টি গরুর সন্ধানে গেলে দেখি, ওয়াসিমের নেতৃত্বে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী লোক এসে গরুগুলো নিয়ে যাচ্ছে। তারা গুলি চালানোর হুমকি দেয়, আর বলে—‘আমাদের সরকার ও পুকিশ আছে, কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।’ আমি কিছু বলার সাহসই পাইনি।”
এই গরুগুলোর আনুমানিক মূল্য পাঁচ লক্ষ টাকার মতো। এই টাকা দিয়েই আব্দুর রহমান নিজের সংসার চালাতেন। এই ঘটনার পর ভয় আর হুমকির কারণে তিনি মুখ খুলতে পারেননি। তবে এখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে সাহস করে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন।
তিনিই প্রথম ব্যক্তি নন—এমন বহু কৃষক অভিযোগ করেছেন, ওয়াসিম ও তার চক্র দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি জনপদের সাধারণ মানুষের গরু, ছাগল ও অন্যান্য মালামাল অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর চোলাই মদের সিন্ডিকেট চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে, যার ফলশ্রুতিতে তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওয়াসিম চক্র এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, কিছু পুলিশ সদস্য পর্যন্ত তাদের কার্যকলাপে নীরব সমর্থন দিয়ে গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারত না। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নেওয়ার—ওয়াসিম ও তার সহযোগী খালেক মেম্বারসহ পুরো চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মানবিক আবেদন: আব্দুর রহমানের মতো অসহায় কৃষকরা যেন আর চোলাই মদের সাথে আসা এই গরু ডাকাত সিন্ডিকেটের শিকার না হয়—এজন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে পুরো চক্রকে ধ্বংস করা দরকার।
চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এই বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছে। তারা বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রযন্ত্র কঠোর হলে এই ভয়ংকর গরু ডাকাতি ও চোলাই মদ পাচারের সিন্ডিকেট ভেঙে সাধারণ মানুষের স্বস্তি ফেরানো সম্ভব। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সেই কুখ্যাত ওয়াসিম, যার বিরুদ্ধে এর আগে গরু ডাকাতি, চোলাই মদ পাচার ও অস্ত্রের মুখে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ উঠেছিল, এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইয়াবা পাচারকারীর ভূমিকায়। গোপন সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান ঢাকায় পৌঁছানোর নেপথ্যে রয়েছে এই ওয়াসিমের পরিচালিত ভয়ঙ্কর মাদক নেটওয়ার্ক। বিশেষ সূত্র দাবি করেছে, সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে আট হাজার পিস ইয়াবা সহ যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের একজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসিমের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে। মাদকবিরোধী সংস্থার এক গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে—ওয়াসিম শুধু নিজে সরবরাহকারী নয়, বরং চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদকের “সেইফ রুট” তৈরি করত। এর মধ্যে নদীপথ, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে তোলা সেফ হাউস রয়েছে।
ওয়াসিমের মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার খবর চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য একেবারেই নতুন নয়। এর আগেও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছিল, রাউজানের পলাতক খালেক মেম্বারকে সাথে নিয়ে ওয়াসিম চোলাই মদ ও ইয়াবার মিলিত কারবারে নামে। বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, রাউজান এবং হাটহাজারী হয়ে ইয়াবার চালান ঢাকায় পাঠানোর গোপন চেইন এখনো সক্রিয় রয়েছে।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, “ওয়াসিমের যোগাযোগ ছিল টেকনাফের কয়েকজন শীর্ষ মাদক ডনের সঙ্গে। সেই সূত্রে সে পাহাড়ি এলাকা ব্যবহার করে নিরাপদ রুট বানিয়ে নেয়।”
চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, এই ইয়াবা পাচারকারীর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, দীর্ঘদিন সে ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কিছু মহলে দখলদারিত্ব ও প্রভাব বিস্তারের ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। তাছাড়া আগের সরকার আমলে পুলিশের কিছু সদস্যের গোপন সহায়তায় সে এই সিন্ডিকেট পরিচালনা করত।
ওয়াসিমের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চট্টগ্রামের কিছু সৎ সাংবাদিক, যারা বিশ্বাস করেন—মাদক, চোরাচালান, গবাদিপশু ডাকাতি ও অস্ত্রবাজির এই ভয়ঙ্কর মিশেল যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে পুরো অঞ্চলটি হয়ে উঠবে 'ড্রাগ রুট'।
পরবর্তী প্রতিবেদনঃ
ওয়াসিমের নগদ অর্থ, জায়গাজমি, এবং কীভাবে মাদক ব্যবসা থেকে তিনি রাতারাতি ‘সম্পদশালী ব্যক্তি’ হয়ে উঠল—পরবর্তী কিস্তিতে প্রকাশ পাবে এই বিতর্কিত চরিত্রের সম্পদ সাম্রাজ্যের নেপথ্য কাহিনী।
চলবে---
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com