ইট-পাথরের ক্লান্ত শহর যেন কখনোই আমাদের থামায়নি, শুধু টেনে রেখেছিল। কিন্তু আজ, সেই বন্ধন ভেঙে বেরিয়ে পড়েছি আমরা—হৃদয়ের সমস্ত উচ্ছ্বাস, শূন্যতায় জমে থাকা স্বপ্ন আর কল্পনার পাল তুলে।
প্রাণের টানে, ভালোবাসার টানে, সংগীতের মায়ায়।
গন্তব্য—বান্দরবনের নীলাচল।
শহরের ধুলোবালি পেরিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে যেন হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল আমাদের সমস্ত ক্লান্তি। পেছনে ফেলে আসা গাঢ় স্মৃতি, হিসাব-নিকাশের ভার, সব যেন ফুরিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে।
আজকের দিন আমাদের—স্বরলিপি সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণের মিলনমেলা,
যেখানে গান মিলবে পাহাড়ের হাওয়ায়,
আর হৃদয় হারাবে সবুজের কোলে।
গাড়ি যখন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোচ্ছে, মনের ভেতরে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।
কেউ হাসছিল নিঃশব্দে, কেউ তাকিয়ে ছিল দূরের পাহাড়ে—
আকাশ যেন সত্যিই হাতছানি দিচ্ছিল,
নীল মেঘের ভাঁজে হারিয়ে যাওয়া কৌতূহলী শিশুর মতো মনকে টেনে নিচ্ছিল মায়াবী প্রকৃতি।
মেঘলা পথ ধরে আমাদের গাড়ি একবার থেমেছিল,
কিন্তু কেউ নামেনি—
শুধু কাচের ওপারে থাকা প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা,
কিছু ছবি, কিছু চাওয়া, আর অপূর্ণতার নীরবতা।
মেঘলাকে একা রেখে এগিয়ে গেলাম নীলাচলের দিকে—
যেখানে অপেক্ষায় ছিল পাহাড়, বাতাস, আর প্রকৃতির আলিঙ্গন।
নীলাচলের সবুজ উঁচুতে দাঁড়ানো মানে
নিজেকে খুঁজে পাওয়া—
একটা নতুন পৃথিবীতে,
যেখানে আকাশ নেমে আসে পাহাড়ের কোলে,
আর সময় থমকে দাঁড়িয়ে গল্প শোনায় শীতল হাওয়ার গলায়।
চারপাশে বিস্তৃত সবুজ,
নীলচে কুয়াশা আর পাখিদের ডাকে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
মন ভরে যাচ্ছিল অপার শান্তিতে—
যেন জীবনের সমস্ত জটিলতা মুছে দিয়ে প্রকৃতি বলছে,
“এই তো তুমি, এতদিন কোথায় ছিলে?”
হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা সমস্ত কথা শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল,
প্রিয়জনদের চোখে ঝলক দিচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া সুখের ছায়া,
আর একেকটা হাসিতে উড়ে যাচ্ছিল ক্লান্ত দিনগুলোর ভার।
কে জানে, এমন দিনে ভালোবাসাও কি একটু বেশি উঁকি দেয় না?
ভাঙা অভিমান, নতুন আলোর পথ
হোটেল রিভার ভিউ—
সেখানে হয়তো রুম বণ্টনের অনিয়ম ছিল,
কিছু ছোট্ট অপ্রস্তুত মুহূর্ত,
কিন্তু প্রকৃতির কাছে এসে কীভাবে অভিমান ধরে রাখা যায়?
সমস্ত তিক্ততা পাহাড়ের হাওয়ায় মিলিয়ে গেল,
ক্লান্ত মন তৃপ্ত হলো রান্নার ঘ্রাণে,
বন্ধুদের হাসিতে,
কথার বুননে।
রাত নামার আগেই আমরা ফিরে এলাম পরিচিত সুরের জগতে,
যেখানে সংগীতের মায়াবী সুর আমাদের আবারও নতুন করে একত্র করল।
গানের পর গান—
কখনো আবেগ, কখনো স্মৃতি,
কখনো ভালোবাসার মধুরতায় ভেসে যাওয়া।
নীলাচলের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল—
সময়ের গতি কি আজ একটু ধীর?
পাহাড়ের কোলে, মেঘের ছায়ায়,
আমরা যেন নিজেদের খুঁজে পেলাম নতুনভাবে।
আমরা আর শহরের ক্লান্ত পথিক নই,
আমরা প্রকৃতির সন্তান—
মুক্ত, সজীব, আনন্দমগ্ন।
রাতের আকাশে জ্বলে উঠেছিল এক ঝাঁক তারা,
আর আমাদের গান মিশে গিয়েছিল পাহাড়ের নীরবতার সঙ্গে।
এই দিন, এই মুহূর্ত—
হৃদয়ের পাতায় গেঁথে থাকবে চিরকাল।
যেখানে হৃদয়ের সুর মিশে যায় সবুজের নীরবতায়-
ফিরে আসার সময়, মনে হচ্ছিল—
নীলাচলের বাতাসে জমে থাকা প্রতিটি মুহূর্ত
আমাদের হৃদয়ে সুরের মতো বাজবে,
ভালোবাসার মতো ছুঁয়ে যাবে বারবার।
প্রকৃতির বুকের মাঝে হারিয়ে যাওয়া এই দিন
শুধু একটি ভ্রমণ নয়,
এটি ছিল নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এক অপার আয়োজন।
আমরা ফিরে যাবো—
ইট-পাথরের শহরে,
কিন্তু হৃদয়ে বয়ে নিয়ে যাবো
নীলাচলের নীরবতা—
যা প্রতিবার মনে করিয়ে দেবে,
একদিন, এক মধুর সকালে
প্রকৃতির ডাকে ছুটে গিয়েছিল কিছু স্বপ্নের পথিক,
যাদের মনে ছিল গান,
হৃদয়ে ছিল ভালোবাসা,
আর চোখে ছিল অপার সবুজের স্বপ্ন।
নীলাচলের নীরবতা আমাদের ভেতরের শূন্যতাকে ভরে দিয়েছিল সুর আর ভালোবাসার বিশুদ্ধতায়। হয়তো এমন দিন আর আসবে না, কিন্তু সেই মুহূর্তের তাজা হাওয়া, হাসি আর গান হৃদয়ের পাতায় রয়ে যাবে আজীবন।