প্রতিদিনের শহরজীবনের ঘূর্ণি থেকে কিছু সময় চুরি করে, আমরা একদল স্বপ্নবিলাসী মানুষ বেরিয়ে পড়েছিলাম বান্দরবনের উদ্দেশে— যেন আত্মা ও শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ছুঁড়ে ফেলে একবার প্রকৃতির কোলে গিয়ে দাঁড়াই। গন্তব্য ছিল নীলাচল। নামেই যেন এক অনন্ত টান—নীলাচল। কোথাও যেন কোনো প্রতিশ্রুতি মিশে আছে এই নামের ভেতর। প্রতিশ্রুতি মুক্তির, প্রশান্তির, ভালোবাসার।
চট্টগ্রামের ইট-কাঠ-পাথরের এই শহরে যেখানে প্রতিদিন আমরা শুধুই ছুটে চলি, মানুষ হয়ে উঠি একটা সময়ের যন্ত্র, সেখানে এমন একটা সকাল শুরু হয়েছিল একেবারে ভিন্নভাবে। আমাদের ছোট্ট কাফেলা, স্বরলিপি সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণের মানুষরা, যেন ভোর থেকেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে উঠেছিল। চোখে ছিল দূর পাহাড় ছোঁয়ার স্বপ্ন, আর মনে ছিল আনন্দে পাগল হবার প্রহর গোনার ব্যাকুলতা।
যাত্রা শুরু হতেই মন যেন পালক হয়ে যায়। বাসের জানালায় চোখ রেখে দেখছিলাম শহরের রঙ ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে—মহাসড়কের কোল ঘেঁষে পাহাড়েরা হাতছানি দিচ্ছে, রোদের আলতো ছায়ায় বোনা এক-একটা দৃশ্য যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। সবুজ মাঠ, পাহাড়ি পথ, নাম না-জানা ফুলের হাসি — সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো রূপকথার দিকে এগোচ্ছি।
নীলাচল পৌঁছতেই যেন নিঃশ্বাসটা বদলে গেল। এক ধরনের নির্মল, ধুলিমুক্ত বাতাস গায়ে এসে ছুঁলো—যা শরীরে নয়, মনে গেঁথে যায়। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর নীল। একদিকে অনন্ত আকাশ, অন্যদিকে ছায়া-ঢাকা পাহাড়ের শোভা। যেন প্রাচীন কোনো গান — চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয়, পাহাড় নিজের গল্প শোনাতে চাইছে।
শহরের ক্লান্ত কণ্ঠগুলো এখানে এসে যেন নতুন সুর পেলো। কেউ হাসছে, কেউ পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মোবাইলে মুহূর্ত ধরে রাখছে, আবার কেউ চুপ করে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সময়কে থামিয়ে রাখতে চাইছে। আমরাও হাঁটছিলাম, ছবি তুলছিলাম, গাইছিলাম, আর বারবার বলছিলাম — "এই মুহূর্তটা হারিয়ে না যাক।"
এই আনন্দ শুধু চোখে দেখা নয়, অনুভবে ছুঁয়ে যাওয়া। একেকটা হাসি যেন জীবনের নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছিল। শিশুদের মতো প্রাণ খুলে উচ্ছ্বাস, কিশোরের মতো কৌতুহল, তরুণের মতো স্বপ্ন, প্রৌঢ়ের মতো স্মৃতি — সব যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল এই পাহাড়ের নীরবতায়।
আর তখনই মনে হলো, শহরের বদ্ধতা থেকে পালিয়ে এসে আমরা আসলে নিজেদের কাছেই ফিরে এসেছি। আমাদের শিল্পীসত্তা, আমাদের মানবিকতা, আমাদের কোমলতা — সবই ফিরে পেয়েছি নীলাচলের চূড়ায় এসে।
এই আনন্দের ভ্রমণ ছিল নিছক ঘোরাঘুরি নয়। এটা ছিল আত্মার মুক্তি। যেখানে আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম — “ভালোবাসা আছে, ভালোবাসা থাকে।” কেউ হয়তো বলেছে, “আরেকবার এমন হোক।” কেউ হয়তো চুপচাপ শুধু মুঠোফোনে আকাশের মেঘের ছবি তুলে রেখেছে। কিন্তু আমরা সবাই জানতাম — এই দিন, এই মুহূর্ত একেকটা জীবনের পুনর্জন্ম।
দিন গড়িয়ে বিকেল যখন পাহাড়ের ছায়া দীর্ঘ হয়, আকাশে মেঘেরা নিজেদের খেলা সাজায়, তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের ধীর বিষণ্নতা নেমে আসে—যাওয়ার সময় আসছে বুঝি। কিন্তু তার মধ্যেও গান চলতে থাকে, গল্প গজিয়ে ওঠে, কেউ আবার নিঃশব্দে চোখ বুজে বাতাস গায়ে মাখে। যেন পাহাড়ের এই নরম গন্ধটা মনেপ্রাণে গায়ে জড়িয়ে নিতে চায়।
আর রাত! রাত হলো এক স্বপ্নের থালার মতো। আকাশে হাজার তারার মিছিল, গানের তালে নাচতে থাকা ছায়ারা, দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা বংশীর সুর — সব মিলিয়ে মনে হলো, জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি। এমন অনুভূতি যে একবার আসে, তারপর হৃদয়ে চিরকালের জন্য জায়গা করে নেয়।
একজন লেখক হয়ে আমি বুঝি, অনেক সময় কলম আটকে যায়, ভাষা মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু আজ এই অনুভবের ভাষা খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হয়নি। কারণ এই মুহূর্তগুলো নিজেরাই কথা বলে। নীলাচলের পাহাড়, তার বাতাস, আকাশের মেঘ, আমাদের হাসিগুলো — সব যেন মিলে মিশে এক কবিতা হয়ে গেছে।
হয়তো এই দিনের ছবি অনেকেই সময়ের ভিড়ে হারিয়ে ফেলবে, হয়তো ছবি ভেসে যাবে মেমোরির ব্যাকআপে, ফেসবুকের টাইমলাইনে ধীরে ধীরে চাপা পড়বে। কিন্তু আমি জানি, আমি এই দিনটিকে নিজের মধ্যে ধরে রাখবো — এক জীবন্ত স্মৃতির মতো।
কারণ এই দিনে আমরা কেবল আনন্দ করিনি, আমরা ভালোবাসতে শিখেছি। আমরা প্রকৃতির কাছে মাথা নত করে বলেছি — “তুমি আছো বলেই আমরা আবার মানুষ হতে পারি।” আমরা ফিরে পেয়েছি একধরনের হারানো প্রশান্তি, যেটা শহরের কোনো বিলবোর্ড, কোনো সেলফি, কোনো কনক্রিট দেয় না।
নীলাচলের সবুজে স্নান করে, আমরা যেন একটা নতুন সকাল নিজের ভেতর খুঁজে পেয়েছি।
এভাবেই একদিন লিখে রাখবো আমি —
"এই আমরা, এসেছিলাম একসাথে — ভালোবাসতে, হাসতে, অনুভব করতে।
এইখানে, নীলাচলের সবুজে, আকাশের চুম্বনে আমরা হয়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সন্তান।
আর এই অনুভব, কোনোদিন মুছে যাবে না।"
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com