বান্দর বন—পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাণের মাঝে এক টুকরো সবুজ নিঃশ্বাস। এখানে যে শুধু গাছ, পাখি আর বানরেরা বাস করে তা নয়—বাস করে কিছু মানুষ, যাদের হৃদয়ে ইতিহাস, চোখে স্বপ্ন, এবং কণ্ঠে সাহসের সত্য উচ্চারণ। এমনই এক মানুষ, যিনি রাজনীতির আলোকবর্তিকা হাতে কখনো নেতৃত্ব দিয়েছেন তৃণমূলকে, আবার অপমান, অবহেলা আর বিকৃত আদর্শের কারণে নিজেই সরে এসেছেন নীরবে—তার নাম কাজী মোঃ মজিবর রহমান।
আমি যেদিন বান্দর বনের স্বরলিপি সংস্কৃতি অঙ্গনে বনভোজনে গেলাম, সেদিন এই মানুষটির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হলো। তিনি কোনো প্রচারপ্রিয় রাজনীতিক নন। তার কণ্ঠে ছিল না প্রচলিত নেতার বুলি, বরং হৃদয় ছোঁয়া এক একজন চিন্তাশীল রাষ্ট্রনায়কের বেদনা। নিজের অতীত, ত্যাগ, বিশ্বাস আর অভিমানের ভাষায় তিনি বলে উঠলেন—
"আমি শেখ হাসিনার রাজনীতি করিনি, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম।"
এই এক বাক্যেই যেন ধরা পড়ল একটি যুগের হতাশা, ক্ষয়, এবং আত্মত্যাগের দীর্ঘ গাথা। কাজী মোঃ মজিবর রহমান সেই মানুষদের একজন, যিনি বঙ্গবন্ধুর ত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন। তিনি তার সোনালি যৌবন উৎসর্গ করেছিলেন আওয়ামী লীগের জন্য, চট্টগ্রামের রাজপথে ছিলেন আপোষহীন সৈনিক। কিন্তু ২০১৬ সালের পর তিনি দলীয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। কেন? কারণ তিনি দেখেছিলেন—আদর্শের জায়গা নিচ্ছে সুবিধাবাদ, নেতার জায়গা নিচ্ছে হাইব্রিড মুখোশধারীরা।
“আজ আওয়ামী লীগ বলতে ভয় লাগে,”—বললেন তিনি।
“আওয়ামী লীগ এখন গালির সমার্থক। এটা কোনোদিন ভাবিনি। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে বুকে ধারণ করতাম, তাদের জন্য এটা গভীর দুঃখের।”
তার চোখে তখন জল জমে ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে এক রক্তক্ষরণ চলছিল। কথায় কথায় উঠে এলো শেখ হাসিনার প্রতি তার অভিমান, এমনকি ঘৃণা—
“শেখ হাসিনার রাজনীতি আমাকে শুধু বিচলিত করেনি, আমাকে বঙ্গবন্ধুকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি আমরা গড়ে তুলেছি, শেখ হাসিনার ভুলের কারণে সেই চেহারা আজ কলঙ্কিত।”
এই মানুষটির বক্তব্যের প্রতি খেয়াল করলে বোঝা যায়—তিনি হিংসা করেন না, তিনি প্রতিশোধ চান না। তিনি কেবল একজন আদর্শিক সৈনিক, যিনি রাজনীতিকে দেখেন জনগণের সেবার পবিত্র পথ হিসেবে, ক্ষমতার জৌলুস বা পারিবারিক রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকার হিসেবে নয়।
তৃণমূল কর্মীদের জন্য তাঁর দরদ ছিল হৃদয়ের গভীর থেকে। তিনি বলছিলেন—
“বান্দর বনের এই মানুষগুলোকে আমি ফেলে আসিনি। ওরা আমার রাজনীতি, ওরা আমার আত্মীয়, আমার জীবন।”
এই বাক্যগুলো ছিল না স্রেফ বক্তৃতার ভাষা। এতে ছিল মাঠের ঘাম, ছিল নিঃস্ব মানুষের কান্না, ছিল এক ব্যর্থ স্বপ্নের লজ্জাহীন স্বীকারোক্তি।
প্রশ্ন উঠতে পারে—তিনি রাজনীতি ছেড়েছেন, তবে কেন আজো এত আবেগ? কারণ, তিনি রাজনীতিকে দেখেন ধর্মের মতো করে, বিশ্বাসের মতো করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার কাছে ছিল এক অবিচল নিয়তি, এবং আজীবন তিনি সেই নিয়তির পথে চলতে চেয়েছেন।
“আমি মরেও বঙ্গবন্ধুর পথ ছাড়বো না,”—এই উচ্চারণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার জীবনের দিশা।
কাজী মোঃ মজিবর রহমান আমাদের চোখে এক রাজনৈতিক চরিত্র নন কেবল, তিনি এক চলমান আত্মজিজ্ঞাসা। আজ যখন বাংলাদেশে রাজনীতির নাম শুনলেই মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন তার মতো একজন নিঃস্বার্থ পথিকের কথা বলাটা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এই মানুষগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি এক সময় সত্যিই আদর্শের জন্য ছিল, মানুষের জন্য ছিল, দেশের জন্য ছিল।
তিনি কোনোদিন এমপি হননি, মন্ত্রীত্ব পাননি, টেন্ডার বা কমিশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। তবু, ইতিহাসের পাতায় যদি কোনোদিন বান্দর বনের রাজনীতির কথা লেখা হয়, সেখানকার একটি বিশুদ্ধ পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম—কাজী মোঃ মজিবর রহমান, যিনি ছিলেন একা, কিন্তু আদর্শবান। ছিলেন অভিমানী, কিন্তু অপরাজেয়।
এই সময়ের যান্ত্রিক ও বিকৃত রাজনীতিতে কাজী মোঃ মজিবর রহমান যেন এক অনতিক্রম্য প্রতিবিম্ব—যার চোখে আগুন, বুকে দেশ, কণ্ঠে সত্য, আর হৃদয়ে সেই বঙ্গবন্ধু, যাকে তিনি কখনোই ছেড়ে যাননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ শাহজালাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন,যুগ্ম-সম্পাদক :মো. কামাল উদ্দিন,
নির্বাহী সম্পাদক : রাবেয়া সিরাজী
বার্তা ও বাণিজ্য বিভাগ : মোতালেব ম্যানশন, ২ আর কে মিশন রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১২০৩।
মোবাইল : 01796-777753,01711-057321
ই-মেইল : bhorerawajbd@gmail.com