বোয়ালখালীর অপরাধ মানচিত্রে আজ এক ভয়ঙ্কর নাম—ওয়াসীম। একসময় যারা তাকে ‘ছোটখাটো মদ ব্যবসায়ী’ বলে খাটো করত, আজ তারা আতঙ্কে তার নাম উচ্চারণ করতেও দ্বিধা করে।
চোলাই মদের গন্ধ ছড়ানো এক ভীতিকর সাম্রাজ্য আর অবৈধ অস্ত্রের ভয়াল ঝনঝনানি দিয়ে ওয়াসীম এখন বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী নদীপথের একচ্ছত্র অপরাধ-প্রভু।
প্রথমে চোলাই মদের অন্ধকার ব্যবসা দিয়ে তার যাত্রা শুরু। সিরিয়া ফরেস্ট ঘাট হয়ে বড়খোলা চাকমাপাড়ার পাহাড়ি কারখানায় প্রতিদিন উৎপাদিত হয় হাজার হাজার লিটার বিষমদ। এসব মদের একমাত্র সমন্বয়ক এবং নিয়ন্ত্রক এখন ওয়াসীম। তার বাহিনী নিশ্চিত করে, তার নির্ধারিত বোট ছাড়া যেন আর কোনো বোট নদী পথে মদ বহন করতে না পারে। কেউ নিয়ম ভাঙলে, ওয়াসীমের অস্ত্রধারী বাহিনী অস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদা আদায় করে, নতুবা চলে ভয়ঙ্কর মারধর। নদী হয়ে উঠেছে ওয়াসীমের ব্যক্তিগত চাঁদাবাজির রাজপথ। ওয়াসীমের অপরাধচক্র কেবল মদেই সীমাবদ্ধ নয়। তার কাছে মজুত রয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র—ওয়ান শুটার গান, শর্টগান, রাইফেল—যেগুলো সে শুধু নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে না, ভাড়া দেয় পলাতক সন্ত্রাসী ও নদী-ডাকাতদের কাছেও। কর্ণফুলী নদীর ডাকাত রিংকু ও সাদ্দাম মেম্বারের অস্ত্রের বড় অংশও এখন ওয়াসীমের হেফাজতে।
তার অপরাধের শেকড় বহু পুরনো। ১৯৯৭ সালে কর্ণফুলী নদীতে প্রকাশ্যে ডাকাতি চালায় ওয়াসীমের দল। সেই সময় পুলিশের বিশেষ অভিযানে তার দলের নেতা আব্দুল হাকিম নিহত হলেও ওয়াসীম কোনোমতে কধুরখীল এলাকায় পালিয়ে যায়। স্থানীয় জনগণ তাকে ধরে নির্মমভাবে গণপিটুনি দিলেও, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। তবে উদ্ধার হয় তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র—যার দুটি আজও ওয়াসীমের অস্ত্রভাণ্ডারে ব্যবহার হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। ওয়াসীমের পরিবারও অপরাধে জড়িত। তার জেঠা মোনাফ চেয়ারম্যানের নির্বাচনী সহিংসতায় ব্যবহৃত অস্ত্রও এখন ওয়াসীমের নিয়ন্ত্রণে। শাশুড় জামাই নির্বাচনের সময় সেসব অস্ত্র দিয়ে খুনোখুনি আর মারামারির ইতিহাস আজো স্থানীয় মানুষের মনে আতঙ্ক হয়ে রয়ে গেছে। সিরিয়া ফরেস্ট ঘাট থেকে মদ সংগ্রহ করে জামাল, বাট্টো নুরুল আলম, ইসমাইল, সাহেরের ছেলে আলমগীরদের মাধ্যমে সে গোটা বোয়ালখালী আর চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে দিচ্ছে চোলাই মদের নেটওয়ার্ক। বন্দর এলাকা, পাহাড়তলী, অক্সিজেন, চাক্তাইসহ শহরের বহু গলিতে এখন ‘ওয়াসীম ব্র্যান্ডের’ মদের সরবরাহ নিরবিচারে চলছে। প্রশাসনের একাংশ ওয়াসীমের বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান চালানোর চেষ্টা করলেও, তার পেছনে থাকা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়া তাকে রক্ষা করে চলেছে। ওসি রাজ্জাক ও এসআই সাইফুল একসময় তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছিলেন, কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপের মুখে তারা কার্যত অচল হয়ে পড়েন। ওয়াসীম এখন ‘অস্পৃশ্য’—তাকে ধরতে সাহস করে না কেউ।
আজ বোয়ালখালীর প্রতিটি নদীপথ, ঘাট, বাজারে ওয়াসীমের বাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। অবৈধ মদের বিক্রির টাকায় তার হাত আরো শক্তিশালী হচ্ছে। তরুণ সমাজের একাংশ এখন তাকে ‘আইডল’ ভাবতে শুরু করেছে—অস্ত্র হাতে নদীর রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
প্রতিবেদকের মন্তব্যঃ
ওয়াসীম—বোয়ালখালীর সেই বিষাক্ত বাতাস, যার বিষে আজ নষ্ট হচ্ছে নদী, সমাজ আর আগামী প্রজন্ম। তাকে দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে একজন চোলাই মদের কারবারি, ডাকাত আর অস্ত্রব্যবসায়ী দিনের পর দিন প্রশাসনের নাকের ডগায় থেকে অপরাধের সিংহাসন গড়ে নিতে পারে। যদি এখনই তাকে গ্রেফতার করে অস্ত্রের ভাণ্ডার উদ্ধার করা না হয়, তবে চট্টগ্রামের একটি বিশাল অঞ্চল খুব দ্রুতই অস্ত্র, চাঁদাবাজি আর বিষমদের অভিশাপে ডুবে যাবে।
ওয়াসীমকে থামাতে না পারলে, আগামী দিনে বোয়ালখালীর মানচিত্র কেবল অস্ত্রের শব্দ আর বিষাক্ত মদের গন্ধের দেশ হয়ে উঠবে—সেখানে আর থাকবে না কোনো স্বপ্ন, কোনো ভবিষ্যৎ।
অবিলম্বে সমন্বিত অভিযান চালিয়ে এই ভয়ঙ্কর অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা জরুরি। সময় এখনই, নইলে কাল হবে অনেক দেরি।